রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর

রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে পাঠাতে পরীক্ষামূলক (পাইলট) প্রকল্পে সহায়তায় এনজিওগুলোর একাংশের সম্মতি মিলেছে। বেশকিছু এনজিও অন্তত এক বছরের রেশন দিতে রাজি হয়েছে। সম্প্রতি এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালকের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে তারা এই সম্মতি দেয়। এরমধ্যে ব্র্যাকসহ বড় কয়েকটি এনজিও রয়েছে। তবে এখনও বেশ কিছু এনজিওর এ ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। অপরদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য ১৯৪টি এনজিও ১ হাজার ২৯১টি প্রকল্পে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৪৪০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বিদেশি তহবিল পেয়েছে।

এর উল্লেখযোগ্য অংশই স্বাস্থ্য খাতে। এসব তহবিল কীভাবে ব্যবহার হয়েছে, তাও নজরদারি করা হচ্ছে।

এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. রাশেদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এর আগে আপত্তি থাকলেও এখন স্বেচ্ছায় অনেক রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে যেতে চায়।

কিন্তু জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর এ ব্যাপারে কিছুটা বিরোধিতা রয়েছে। তিনি বলেন, পাইলট প্রকল্প হিসাবে ৫শ’ থেকে ১ হাজার রোহিঙ্গাকে সেখানে নেয়া যেতে পারে।

এক্ষেত্রে কক্সবাজারে বর্তমানে যে রেশন পায়, সেটি নিশ্চিত করতে পারলেই সমস্যা মিটে যায়। কিন্তু জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সহায়তা পাওয়া এনজিওগুলোর আইনগত বাধা আছে।

ফলে আমাদের অন্য যেসব এনজিও আছে, তাদের এক বছর রেশন দেয়ার সমর্থ আছে কিনা সেটি আমরা জানতে চেয়েছিলাম। বেশকিছু এনজিও মত দিয়েছে, তাদের সে সমর্থ রয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা ৮৮টি এনজিওকে আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু ২২ থেকে ২৩টি এনজিও এসেছিল। এরমধ্যে ব্র্যাকের মতো এনজিও এসেছিল।

অনেকে আবার টেলিফোনে জানিয়েছে, তারা ভাসানচরের ব্যাপারে রাজি। ব্র্যাক অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জের সিনিয়র ডিরেক্টর কেএএম মোরশেদ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যাপার। আমরা এখানে কোনো পার্ট নই।

তবে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থার মতো ব্র্যাকও মানবিক সহায়তা দিচ্ছে। এখানে আমরা ট্রিপল আরসির (শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন) নীতিমালা অনুসরণ এবং ইন্টার সেক্টরাল কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি।

মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনে দেশটি থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য নোয়াখালীর ভাসানচরে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক সুবিধা সংবলিত পরিকল্পিত অস্থায়ী আবাসন প্রকল্প।

সরকারের সবচেয়ে বেশি প্রাধান্যের এ প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১শ’ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে এখানে ১ লাখ লোকের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ব্রিটিশ কোম্পানির ডিজাইনে শক্তিশালী বাঁধ দিয়ে দ্বীপকে সুরক্ষিত করা হয়েছে।

নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং পরিবেশসম্মত এ নগরীতে যে কোনো পরিস্থিতিতে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনের লক্ষ্যে, ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, থানা, বাজার এবং ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রসহ সব সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে এখানে।

জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং এনজিদের জন্য রয়েছে পৃথক ভবন। প্রকল্পটি নির্মাণ, বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা করছে নৌবাহিনী।

তবে অভিযোগ রয়েছে, আন্তর্জাতিক সংস্থার দোহাই দিয়ে এনজিওরা সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের নিরুৎসাহিত করছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কোনো কথা বলতে রাজি হননি একশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির।

সম্প্রতি অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছেন, রোহিঙ্গারা যাতে ভাসানচরে না যায়, সেজন্য জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর চাপ রয়েছে। মন্ত্রী বলেন, ভাসানচর অত্যন্ত সুন্দর জায়গা।

কিন্তু সেখানে ফাইভ স্টার হোটেল নেই। আর এনজিওগুলোর কর্তারা কক্সবাজারে মোজ মাস্তি করেন। এ কারণে তারা ভাসানচরে যেতে চান না। বর্তমানে দেশে বৈদেশিক অনুদান নিয়ে কাজ করে এমন দেশি-বিদেশি দুই হাজার ৬২৫টি এনজিও রয়েছে।

এর মধ্যে বিদেশি এনজিও ২৫৯ এবং দেশি দুই হাজার ৩৬৬। আর রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে এমন এনজিও সংখ্যা ১৯৪টি। যার মধ্যে আবার দেশি ১৩৮ এবং বিদেশি ৫৬টি।

রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করা এসব এনজিওর বিপরীতের ১ হাজার ২৯১টি প্রকল্পে ৩ হাজার ৪৪০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বিদেশি সহায়তা এসেছে।

এনজিও ব্যুরো সূত্র বলছে, রোহিঙ্গাদের এখনও শরণার্থী স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ সরকার। কারণ এই স্বীকৃতি পেলেই সেটি জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) আওতায় চলে যাবে।

ওই সময়ে তাদের থাকা-খাওয়াসহ সব দায়িত্ব জাতিসংঘ বহন করবে। তবে ইউএনএইচসিআরের অনুমতি ছাড়া তাদের কোথাও পাঠানো যাবে না। ফলে রোহিঙ্গাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোনো তহবিল ছাড় করা হচ্ছে না।

বর্তমানে রোহিঙ্গাদের যে প্রকল্পে সহায়তা দেয়া হচ্ছে তাকে বলে এফডি (ফরেন ডোনেশন)। জরুরি সহায়তার এই প্রকল্প ব্যবহার করা হয়। আবেদনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থ ছাড় করা হয়।

জাতিসংঘ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, এমন যে কোনো সংস্থাই অর্থায়ন করতে পারে। তবে অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে ট্রিপল আরসি এবং জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে করতে হয়।

ট্রিপল আরসির সর্বশেষ তথ্য অনুসারে দেশে মোট নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ১১ লাখ ১৮ হাজার। দুই প্রক্রিয়ায় ৮ লাখ ৬৭ হাজার জনকে খাদ্য সহায়তা হচ্ছে।

এরমধ্যে সাধারণ খাদ্য বণ্টনের আওতায় ৪ লাখ ৬২ হাজার এবং ই-ভাউচারের আওতায় ৪ লাখ ৪ হাজার জন। সাধারণ খাদ্য বণ্টন কর্মসূচিতে ১ থেকে ৩ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের জন্য মাসে ৩০ কেজি চাল, ৯ কেজি ডাল এবং ৩ লিটার তেল দেয়া।

এছাড়া ৪ থেকে ৭ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের জন্য ৬০ কেজি চাল, ১৮ কেজি ডাল এবং ৬ লিটার তেল দেয়া হয়। এভাবে পরিবারের সদস্য সংখ্যা যত বেশি, রেশিও অনুসারে খাবার দেয়া হয়।

আর ই-ভাউচারের আওতায় যারা আছেন, তারা দোকান থেকে জনপ্রতি ২১শ’ ক্যালোরি সমান খাদ্য নিতে পারে। এক্ষেত্রে বরাদ্দ সর্বোচ্চ ৭৮০ টাকা। তবে এনজিওদের কার্যক্রম স্বাস্থ্য খাতে বেশি।

কারণ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুসারে ৩ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা অপুষ্টিতে ভুগছে। আর বিদেশি সহায়তার বড় অংশই সরকারিভাবে আসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *