সেই নূরজাহান এখন ঢাকায় চিকিৎসাধীন

বিশেষ প্রতিনিধি : মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর ছোড়া মর্টার শেলের টুকরো নিয়ে ৫০ বছর ধরে অলৌকিকভাবে বেঁচে থাকা সেই নূরজাহান বেগম প্রশাসনের সহযোগিতায় বর্তমানে ঢাকা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক খ্যাতিমান চিকিৎসক ডা. জাহেদ হোসেন এর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সোমবার (২৬ এপ্রিল) বিকেল ৩টার দিকে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. জাহেদ হোসেন মুঠোফোনে বলেন, নূরজাহানকে সোমবার সকালে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। উনার বিষয়টি জটিল। তাই উন্নত চিকিৎসার জন্য আমরা একটা মেডিকেল বোর্ড গঠন করবো। বোর্ড যদি সিদ্ধান্ত নেয় অস্ত্রপাচার করে মর্টার শেলের টুকরো বের করা যাবে তাহলে শেলের টুকরো বের করা হবে। ৫০ বছরে যখন শেলের টুকরো নিয়ে উনি এখনো বেঁচে আছেন ইনশাআল্লাহ তিনি যাতে সুস্থ হয়ে উঠেন সেজন্য আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। গত ২৪ এপ্রিল কালের কণ্ঠের প্রিন্টে “মাথায় যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে ৫০ বছর” ও অনলাইনে “ মাথায় মর্টার শেল নিয়ে ৫০ বছর বেঁচে আছেন তিনি“ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের নির্দেশে ওইদিনই বিকেলে যুদ্ধাহত নূরজাহানের সার্বিক খোঁজখবর নেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফেরদৌস আক্তার। তারা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি বিভাগ) ডা. সাঈদ এনামের সাথে পরামর্শ করে নূরজাহান বেগমকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরণের ব্যবস্থা করেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ মাতৃকার টানে নূরজাহানের স্বামী নুরু মিয়া যুদ্ধে চলে যান। বাড়িতে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী নূরজাহান বেগমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। একপর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্তঘেষা আমোদাবাদ এলাকায় হামলা চালায়। মর্টার শেলের হামলায় গুরুতর আহত হন নূরজাহান বেগম। শেলের আঘাতে নূরজাহানের মস্তিষ্ক, বাম হাত ও বাম পায়ের উরুতে আঘাত লাগে। সে সময় তিনি কাকতালীয়ভাবে বেঁচে যান (৭০)। কিন্তু নূরজাহানের মস্তিষ্কের ভেতরে রয়ে যায় মর্টার শেলের একটি টুকরো। সেই টুকরো নিয়ে তিনি আজ ৫০ বছর ধরে এখনো বেঁচে আছেন। বর্তমানে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার থাকার কারণে নূরজাহানের স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে শুরু করেছে। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, মস্তিষ্কে মর্টার শেলের একটি টুকরো রয়ে যাওয়ায় সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
নূরজাহানের মূল বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার উত্তরী ইউনিয়নের আমোদাবাদ এলাকায়। বর্তমানে তাঁদের পরিবার কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের লংলা খাসের নতুন বস্তি এলাকায় বসবাস করছেন।
নূরজাহানের বড় ছেলে সৌদি আরবপ্রবাসী মোবারক হোসেন বলেন, ডা. সাঈদ এনাম ও ইউএনও স্যারের সহযোগিতায় আমার মাকে রোববার রাতে এ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ও নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি ডা. জাহেদ হোসেন এর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সবার নিকট দোয়া চাই আমার মা যেন সকলের দোয়ায় সুস্থ হয়ে উঠেন।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি বিভাগ) ডা. মো. সাঈদ এনাম বলেন, নূরজাহানের মস্তিষ্কে এক্সরে ও সিটিস্ক্যান করে তাঁর মস্তিষ্কের ভিতরে মর্টার শেলের একটি টুকরোর অবস্থান দেখা যায়! এরকম ঘটনা অলৌকিক এবং বিস্ময়কর। গত ৫০ বছরে এই শেলের টুকরো তার মস্তিষ্কের প্রায় এক তৃতীয়াংশ গলিয়ে ফেলেছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘পরেনসেফালী’ (Porencephaly)| এমন পরেনসেফালী নিয়ে ৫০ বছর বেঁচে থাকাটা সারা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্যে বিরল ঘটনা। নূরজাহান বেগমকে বর্তমানে ঢাকায় প্রফেসর ডা. জাহেদ হোসেন স্যারের অধীনে ভর্তি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে স্যার সকল ব্যবস্থা সু-সম্পন্ন করে রেখেছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ওই নারীর সার্বিক খোঁজখবর নিয়ে চিকিৎসার সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসক স্যারের সাথে কথা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।

কুলাউড়ায় মুক্তিযুদ্ধে আহত নূরজাহানের মস্তিষ্কের ভেতর মর্টার শেলের টুকরো!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *