মানুষের প্রয়োজনে মানবিক পুলিশ সফির বিরামহীন ছুটে চলা

মাহফুজ শাকিল : মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য/একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু ‘গল্পের শুরুটা করোনাময় জীবনকে ঘিরেই। সিলেট নগরীতে মোটর সাইকেলে যোগে গায়ে পুলিশের পোশাক। এক রোগীর স্বজনের জরুরি ফোন পেয়ে পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে মোটরসাইকেলে হাসপাতালের দিকে ছুটছেন এক যুবক- এমন একটি ছবি মঙ্গলবার দিনভর ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। সর্বমহলে আবারো ভূয়সী প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। ঘটনাটি গত (৯ আগষ্ট) সোমবারের। ছবিটি সিলেট শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল এলাকা থেকে তোলা হয়েছে বলে জানা গেছে।

আর যিনি মানুষের প্রয়োজনে এমন মানবিক কাজটি করে চলেছেন তিনি হলেন সিলেট মহানগর পুলিশের নায়েক সফি আহমেদ। তাকে মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে সবাই জানে। প্রতিবেদনের শুরুতে যে বাংলা গানের গীতি কবিতা দিয়ে বলা হয়েছিল তেমনি তিনি কাজ করছেন সব বাধা পেরিয়ে। গত বছর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই মানবিক সহায়তা কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসেন সফি। সিলেট মহানগর পুলিশের মিডিয়া ও কমিউনিটি সার্ভিস বিভাগে কাজ করেন সফি। সিলেটে মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ, বেড়েছে অক্সিজেনের চাহিদাও। এমন পরিস্থিতিতে অসহায়দের বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিয়ে মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন পুলিশ সদস্য সফি আহমেদ।

সফি আহমেদ এই করোনা বিপর্যয়ে সিলেটের এক মানবিক পুলিশ সদস্যের নাম। করোনা বিপর্যয়ের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আছেন মানুষের প্রয়োজনের জন্য। কখনও দরিদ্র মানুষের বাড়ি বাড়ি খাবার নিয়ে, আবার কখনো কখেনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য। এ যেন এক অবাক সুর্যোদয়ের নাম। সিলেটে এক বছরের বেশি সময় চলছে চলমান সফির এ কার্যক্রম। এ কাজে আরও কিছু তরুণকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন বীর হিরো মানবিক টিম নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে খাদ্য বিরতণ, প্লাজমা, অক্সিজেন সিলিন্ডার, ওষুধসহ চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ করে যাচ্ছেন তারা।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি সম্পর্কে মানবিক টিমের প্রধান সমন্বয়ক সফি আহমদ বলেন, ‘ গত সোমবার দুপুরে আমি নগরের শেখঘাট এলাকার একটি টিকাদান কেন্দ্রে ডিউটিতে ছিলাম। এমন সময় অচেনা নম্বর থেকে দুইটি ফোন আসে। জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রয়োজন। রোগী শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি।’ সফি বলেন, ‘একটু পরই আমার ডিউটি শেষ হয়। আমার মোটরসাইকেল তখন আরেকজন নিয়ে গেছেন। আমি আরেকজনের মোটরসাইকেল নিয়ে বাসায় রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে বেঁধে হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে শুনি রোগীকে শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। স্বজনরা তাকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। এরপর আমি দুটি অক্সিজেন সিলিন্ডার ওসমানীতে পৌঁছে দেই।’ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আশপাশ থেকে কেউ ছবি তুলে ফেসবুকে আপ করেন বলে জানান সফি। অক্সিজেন সিলিন্ডার দেয়া দুই রোগীরই করোনার উপসর্গ রয়েছে। তবে তারা এখন অনেকটা সুস্থ আছেন বলে জানান তিনি।

সিলেট নগরের মদিনা মার্কেট এলাকার বাসিন্দা মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত বলেন, ঈদের ঠিক আগের দিন আমার বাবা সিলেটের রাগীব রাবেয়া হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। হঠাৎ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, বাবার অক্সিজেনের সংকট দেখা দিয়েছে। অক্সিজেন আসতে সময় লাগবে আরও দুই ঘণ্টা। এমন অবস্থায় কোনো উপায় না পেয়ে সফি আহমদকে ফোন দিলে আধা ঘণ্টার মধ্যে তিনি একটি সিএনজি দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসেন। এমনকি নিজে কাঁধে করে তিন তলা বেয়ে সিলিন্ডার নিয়ে আসেন। ওইদিন উনি এই সাহায্য না করলে হয়তো কোনো অঘটন ঘটতে পারত। আমি আসলেই উনার প্রতি কৃতজ্ঞ। উনার কারণে সিলেটের অনেক মানুষই উপকৃত হচ্ছেন। দোয়া করি, তিনি তার এই কাজের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন।

নিজের কার্যক্রম সম্পর্কে সফি বলেন, ‘গত বছর ২৬ মার্চ থেকে আমরা সহায়তা কর্মসূচি শুরু করি। লকডাউনে বিপাকে পড়া দরিদ্র মানুষদের সহায়তার জন্যই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। প্রথমে খাদ্য সহায়তা করতাম। এখন সহায়তার পরিধি আরও বিস্তৃত হয়েছে। আরও অনেকে আমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।’দেশে ও প্রবাসের অনেকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন বলেও জানান সফি। এখন ২৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত রয়েছে জানিয়ে সফি বলেন, ‘ফোন পেলেই বীর হিরো মানবিক টিমের সদস্যরা অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেন। মাত্র ২৫টি সিলিন্ডার নিয়ে সেবা দিতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। অক্সিজেনের জন্য আমাদের কাছে প্রতিদিন শ খানেক ফোন আসে।’ সফি বলেন, ‘অনেকে আমাদের টাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ অক্সিজেন সিলিন্ডার দান করেছেন। আমরা সেগুলো মানুষের প্রয়োজনে পৌঁছে দিচ্ছি।’ অক্সিজেন সেবা ছাড়াও রোগীর প্রয়োজনে প্লাজমা সংগ্রহ করে দিচ্ছে সফির মানবিক টিম। সফি বলেন, ‘আজও আমরা দুইটা প্লাজমা সংগ্রহ করে দিয়েছি। এভাবে প্রতিদিনই একটা-দুইটা প্লাজমা দিতে হয়। এ ছাড়া আমাদের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিও অব্যাহত আছে। হতদরিদ্র কিছু রোগীর জন্য ওষুধও সংগ্রহ করে দেই।’ সফি জানান, দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, অসহায় শিক্ষার্থী ও হতদরিদ্র মানুষদের সাহায্য শুরু করেন তিনি। কখনও চাল, ডাল, নুন, তেল দিয়ে, কখনও রান্না করা খাবার দিয়ে। রক্ত ও প্লাজমা সংগ্রহ করে দেন। আবার করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফনেও সহায়তা করে মানবিক টিম। তবে এখন অক্সিজেন সেবাই বেশি দিতে হচ্ছে।

করোনা আক্রান্ত রোগী ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের জটিল ও মরণব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের সহযোগিতা করে আসছেন সফি। নিজের বেতনের টাকা দিয়ে অনেক পরিবারের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন। করোনার ভয় উপেক্ষা করে ছুটে চলেছেন অবিরত। পেয়েছেন মানবিকতার পুরস্কারও। মানবিক নানা কাজে অবদানের জন্য গত ১১ মার্চ সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মাসিক কল্যাণ সভায় নায়েক সফি আহমেদের হাতে সম্মাননা তুলে দেন এসএমপি কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ। পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফের অনুপ্রেরণায় তাঁর এ কর্মযজ্ঞ অব্যাহত আছে।

সফির কার্যক্রম সম্পর্কে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের গণমাধ্যম কে বলেন, ‘পুলিশের কমিউনিটি সার্ভিস কার্যক্রমেরই একটি অংশ স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে মানুষকে সহায়তা করা। আমাদের টিমের সদস্য হিসেবে সফি এসব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ‘তার মানবিক কর্মকাণ্ড প্রশংসার দাবিদার। আমরা সবসময়ই তাকে উৎসাহ দিই। এসব কাজ পুলিশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করে। তার সঙ্গে অনেক শিক্ষার্থীরাও স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছে।’ এ ছাড়া ইতিমধ্যে যখন দেশে করোনা আক্রান্তদের দাফনসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করে পুলিশ অনেকটা সুনাম অর্জন করেছে। তবে অনেকটা প্রকৃত ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হয়ে কাজ করছেন সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) এক সদস্য। যিনি এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার পরিবারকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্য ও নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা দিয়েছেন। অথচ তিনি কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও নন; পুলিশের একজন নায়েক! তিনি প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছে থাকলে কাজের মধ্যে থেকেও মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসা যায়। প্রয়োজন শুধু মানসিকতা।

সফির গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার কাদিপুর ইউনিয়নের চাতলগাঁও গ্রামে। বাবা মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মো. ইদ্রিছ আলীও ছিলেন একজন পুলিশ সদস্য। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট সফি ২০১৪ সালে পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগ পান। পরবর্তীকালে নায়েক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। পুলিশের একেবারেই মাঠপর্যায়ে কাজ করার পরও কিভাবে মানুষের সেবা করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই বাবার দেশপ্রেম দেখতাম। এই সংকটময় সময়ে প্রথমে নিজের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। পরে অন্য মানুষেরও দুঃখ সহ্য করতে পারিনি। ফলে বাবার পেনশনের টাকা ও মুক্তিযোদ্ধার ভাতা, আত্মীয়, বন্ধু ও সিনিয়রদের সহায়তায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে সাধ্যমতো সেবা দেয়ার চেষ্টা করি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *