লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে রাস্তা পাঁকা হচ্ছে কার স্বার্থে? হাজার হাজার কোটি টাকার সেগুন বাগান নিয়ে সঙ্কিত বনবিভাগ

জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার :

বনবিভাগের তিন দফা বাধার পরও মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের ভেতরে কাঁচা রাস্তা পাকাকরণের কাজ শুরু করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তবে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন অনুমোদন না নেয়ায় কাজ বন্ধ রাখতে বন বিভাগের পক্ষ থেকে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলীকে তিন দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা উপেক্ষা করে রাস্তার কাজ দিব্যি চলছে।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সংরক্ষিত বনের ভেতরে পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হলে কয়েক হাজার কোটি টাকার পুরনো সেগুন বাগান রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং বনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে, বনের ভেতরে থাকা ভিলেজারদের দাবি, রাস্তাটি পাঁকা হলে তাদের যাতায়াতে অনেক সুবিধা হবে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, লাঠিটিলা এলাকায় লালছড়া থেকে রুপাছড়া পর্যন্ত কাঁচা সড়কের শুরু থেকে এক কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণ কাজের জন্য এলজিইডি দরপত্র আহ্বান করে। প্রায় ৯৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘প্যারাডাইস কনস্ট্রাকশন’ নামের স্থানীয় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি পায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেশ কয়েকদিন থেকে কাজের জন্য সড়কের পাশে ইট স্তূপ করতে শুরু করে এবং এক্সেভেটর দিয়ে মাটি কাটার কাজ শুরু করেছে। বন বিভাগের লোকজন বিষয়টি জানতে পেরে মৌলভীবাজার জেলার (শ্রীমঙ্গল) সহকারী বন সংরক্ষককে লিখিতভাবে জানান। এর আগে ১০ এপ্রিল স্থানীয় লাঠিটিলা বিটের বিট কর্মকর্তা মোঃ সালাহ উদ্দিন এবং ১৪ এপ্রিল রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ আলাউদ্দিন রাস্তার কাজ বন্ধ রাখতে এলজিইডির উপজেলা কার্যালয়ের প্রকৌশলীর কাছে পৃথক পৃথক চিঠি দেন। ওই চিঠিতে সংরক্ষিত বন এলাকায় কোনো ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না করার বিষয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছিল এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করার অনুরোধ করেন। এছাড়া রাস্তাটির কাজের দরপত্র আহ্বানের আগে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো পরামর্শ বা অনুমোদন নেয়া হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া বিট কর্মকর্তা মোঃ সালাহ উদ্দিন ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সংরক্ষিত বন এলাকায় নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ হতে বিরত থাকার জন্য এলজিইডি’র উপজেলা প্রকৌশলীকে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। কিন্তু জুড়ী এলজিইডি সে সকল চিঠিকে তোয়াক্কা না করে রাস্তার কাজ শুরু করে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, লাঠিটিলা এলাকার পুরাতন সেগুন বাগানের ভেতরে কাঁচা রাস্তা পাকা করণের জন্য এক্সেভেটর দিয়ে রাস্তা খোদাই করে বক্স করা হচ্ছে। রোববার পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ ফুট রাস্তায় মাটি খোদাই করে রাখা হয়েছে। রাস্তার শুরুর প্রান্তে ইট স্তুপ করে রাখা হয়েছে। বনের ভেতরে রাস্তার উভয়পাশে সারি সারি পুরাতন সেগুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালি মনোরম প্রাকৃতিক বনের দৃশ্য রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, গত কয়েকদিন আগে কাজ শুরু করেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।

বন বিভাগ জানায়, লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের আয়তন ৫ হাজার ৬৩০ দশমিক ৪০ একর। সেখানে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার মূল্যের প্রায় ৫০ হাজার পুরাতন সেগুন গাছ, প্রাকৃতিক বন, সৃজিত বিভিন্ন ধরনের বনজ গাছের বাগান, বাঁশমহাল ও বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণী রয়েছে। এটি সিলেট বিভাগের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ বনাঞ্চল।

বন বিভাগ আরো জানায়, বনভূমির মধ্যে যেকোন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণসংক্রান্ত বিষয়ে ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিবের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সভার সিদ্ধান্ত মতে, উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে বনভূমির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল, প্রজনন ক্ষেত্র হ্রাস পাচ্ছে, নির্জন পরিবেশ সংকুচিত হচ্ছে। বন, বনভূমি, পরিবেশ, প্রতিবেশ, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিঘিœত হচ্ছে। তাই বনভূমির মধ্যে যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে বন বিভাগের মাধ্যমে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেয়ার কথা বলা হয়। এ ছাড়া সব উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত ও নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় রাখতে বলা হয়। পরে সভার কার্যবিবরণীর বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিচালক-১৪ ড. মোঃ সহিদউল্যাহ স্বাক্ষরিত চিঠি দেওয়া হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য বাবুল আহমেদ, রুপাছড়ার বাসিন্দা শামীম উদ্দিন ও আবু তাহের বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকে এই বনের ভেতরে ভিলেজার হিসেবে বসবাস করে আসছি। আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে মাননীয় মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন মহোদয়ের উদ্যোগে এই এলাকায় রাস্তা পাকাকরণের কাজ শুরু হয়েছে। এখানে রাস্তা হলে আমাদের যাতায়াতে অনেক সুবিধা হবে। বন বিভাগ সেগুন পাচারের অহেতুক চিন্তা করছে। কাঁচা রাস্তা দিয়েওতো সেগুন পাচার করা যায়, এই সংরক্ষিত বন থেকে কোন সেগুন গাছ কখনো চুরি হতে আমরা দেখিনি।

জুড়ী বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ আলাউদ্দিন বলেন, লাঠিটিলা বনে রাস্তার কাজের ব্যাপারে কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। পাকা রাস্তাটি হলে ওই এলাকার পুরনো সেগুনবাগান রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। কাঠ চোরাকারবারিদের তৎপরতা বেড়ে যাবে। এ কারণে কাজ বন্ধ রাখতে এলজিইডি প্রকৌশলীকে বনবিভাগের পক্ষ থেকে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছি এবং উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি।

এলজিইডি’র জুড়ী উপজেলা প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল মতিন এ ব্যাপারে বলেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী স্থানীয় মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা) আসনের সাংসদ মো. শাহাব উদ্দিনের নির্দেশে কাজ করানো হচ্ছে। সংরক্ষিত বনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে কিভাবে কাজ শুরু করলেন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনুমতির ব্যবস্থা মন্ত্রী মহোদয় করবেন এছাড়া এ বিষয়ে আমার আর কোন বক্তব্য নেই।

এলজিইডি’র মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আজিম উদ্দিন সরদার এ ব্যাপারে বলেন, লাঠিটিলা এলাকাটি মাননীয় মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন মহোদয়ের নির্বাচনী এলাকা জুড়ী উপজেলার মধ্যে পড়েছে তাই তিনি ডিও লেটারের মাধ্যমে ওই এলাকায় এক কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব করেন। বিষয়টি মন্ত্রী মহোদয়ের জানা তাই আলাদাভাবে চিঠি দিয়ে অনুমতি নেয়া হয়নি। তবে এই এলাকায় পাকা রাস্তা হলেও বনের পরিবেশ যেন ঠিক থাকে এবং সেগুন পাচার যাতে না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ যেন নজরদারি রাখে। কাজ শুরু করার পর বনবিভাগ আপত্তি দিলে বিষয়টি জেনে উপজেলা প্রকৌশলীকে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে পরামর্শ করে কাজ শুরু করার কথা বলেছি।
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রাস্তার বিষয়ে খবর নিয়ে পরে জানাবো। -দি নিউ নেশন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *