করোনার নতুন স্ট্রেন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ব্রিটেন

রায়হান আহমেদ তপাদার : ব্রিটেনে করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর যে মিছিল সেটার গতি কিছু কমলেও আক্রান্তের সংখ্যা গড়ে পাঁচ হাজার থেকে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন এই আক্রান্তের সংখ্যার পরিসংখ্যানের উপর বাড়তে পারে মৃত্যুর এই মিছিল। আর তাই সরকারকে বেশ জোরেশোরে প্রস্তুত থাকতে বলছেন তারা করোনার নতুন স্ট্রেন নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে গোটা বিশ্বে। ভারতসহ প্রায় ১২টি দেশ ব্রিটেন থেকে আগত বিমান পরিষেবা স্থগিত করেছে। এখনও অবধি কমপক্ষে পাঁচটি দেশে নতুন করোনা স্ট্রেনের দেখা মিলেছে। এছাড়া বিশ্বের অন্য দেশও আতঙ্কে কাঁপতে শুরু করেছে। এবং ডেইলি মেইলের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ব্রিটেনের পাশাপাশি ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া এবং ইতালিতেও নতুন করোনা স্ট্রেন মিলেছে। ব্রিটেনের এক যাত্রী রোমে এসেছিলেন, যার জেরে ইতালিতেও মেলে এই ভাইরাসের স্ট্রেন। নতুন ভাইরাস সম্পর্কে ফ্রান্সকেও সতর্ক করা হয়েছে। ফ্রান্স জানিয়েছে, খুব সম্ভবত তাদের দেশেও করোনার নতুন স্ট্রেন পৌঁছে গেছে। মিউটেশনের জেরে সৃষ্ট নতুন করোনা ভাইরাসটিকে আরও সংক্রামক হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ব্রিটেনে হু হু করে করোনা সংখ্যা বাড়ার পিছনে রয়েছে এই রোগই।বিশেষজ্ঞরা বলছেন করোনা ভাইরাসের নতুন স্ট্রেন ৭৯ শতাংশ সংক্রামক। নভেম্বরেই ডেনমার্কে করোনার ভাইরাসের নতুন স্ট্রেনের ৯টি এবং অস্ট্রেলিয়ায় একটির সন্ধান পাওয়া গেছে। নেদারল্যান্ডস জানিয়েছে চলতি মাসে করোনার ভাইরাসের একটি নতুন স্ট্রেন ফের পাওয়া গেছে।

অপরদিকে বেলজিয়ামের ক্ষেত্রে এখনও নিশ্চিত করা হয়নি যে সেটি আদৌ করোনার নতুন স্ট্রেন কিনা।এখনও অবধি তথ্য জানাচ্ছে, ব্রিটেনের লন্ডনে করোনার ভাইরাসের নতুন স্ট্রেন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। যার জেরে কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রয়েছে ব্রিটেন। ফরাসী স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, করোনার নতুন স্ট্রেন যে ফ্রান্সে পৌঁছে গিয়েছে এমন সম্ভাবনা পুরো মাত্রায় রয়েছে। উত্তর আয়ারল্যান্ডের প্রথম মন্ত্রীও জানিয়েছেন যে, সম্ভবত তাদের দেশেও করোনার নতুন স্ট্রেন পৌঁছে গেছে। ব্রিটিশ গবেষকরা লন্ডন এবং আশে-পাশের অঞ্চলে যে ভাইরাসের বিস্তার দেখছেন, সেটিকে তারা নিউ ভ্যারিয়েন্ট, অর্থাৎ নতুন বৈশিষ্ট্যের ভাইরাস বলে বর্ণনা করছেন।তবে এটি যে আগেরটির চেয়ে অনেক বেশি প্রাণঘাতী বা মারাত্মক, সেরকম প্রমাণ তারা এখনো পাননি।এটিকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের টিকা যে ভিন্ন ফল দিতে পারে – এমন কথাও তারা বলছেন না।ব্রিটেন ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসেও এ ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে বলা হচ্ছে। ব্রিটেনে করোনাভাইরাসের নতুন প্রজাতি শনাক্তের পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। একের পর এক দেশ থেকে আসছে ব্রিটিশ ফ্লাইট নিষিদ্ধের ঘোষণা। এর প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে ও দেখা দিয়েছে নিম্নগতি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শেয়ারবাজার এসঅ্যান্ডপি ৫০০-এর সূচক নিচে নেমেছে অন্তত ১ শতাংশ। ডো জোনস এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানশাসিত নাসদাকেরও অনেকটা একই অবস্থা।

এদিকে লন্ডনের এফটিএসই ১০০-এর লেনদেন কমেছে অন্তত ২ শতাংশ। জার্মানি এবং ফ্রান্সের প্রধান শেয়ারবাজার গুলোর সূচক নেমেছে ৩ শতাংশের বেশি। ব্রিটেনের ওপর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় ধস নেমেছে ব্রিটিশ এয়ারলাইনগুলোর শেয়ারে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের মালিক আইএজি’র দর কমেছে একধাক্কায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ইজিজেটের অবস্থা আরও খারাপ। তাদের শেয়ারের সূচক নেমেছে ৯ শতাংশ নিচে। বিমানের ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী রোলস-রয়েসের শেয়ারেও দেখা গেছে বাজে অবস্থা। তাদের সূচক কমেছে অন্তত ৮ শতাংশ। স্বস্তিতে নেই ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলোও। এয়ার ফ্রান্স-কেএলএমের শেয়ারের সূচক কমেছে ৫ শতাংশ। একই পরিমাণ ধস বিমাননির্মাতা এয়ারবাসের। শুধু শেয়ারবাজারেই নয়, নতুন করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে যুক্তরাজ্যের মুদ্রার মানেও। ইউরোর বিপরীতে ইতোমধ্যেই ১ শতাংশ কমেছে পাউন্ড স্টার্লিংয়ের মান, মার্কিন ডলারের বিপরীতে তা কমেছে অন্তত ১ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড-১৯ মহামারির আঘাত সামলে ২০২১ সালে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে গতি আশা করা হচ্ছিল, নতুন ভাইরাস প্রজাতির কারণে সেই সম্ভাবনা মিলিয়ে যেতে বসেছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া করোনা ভাইরাসের নতুন প্রজাতি ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রামক। পুরনো প্রজাতির চেয়ে এটি আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে ভাইরাসটি খুব বেশি প্রাণঘাতী বা ভ্যাকসিনের সঙ্গে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাবে, এখনও তেমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এর আগে, ইউরোপের একের পর এক দেশ থেকে যুক্তরাজ্যের ফ্লাইট বাতিলের খবর আসতে থাকে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে প্রথম ফ্লাইট বাতিলের ঘোষণা দেয় নেদারল্যান্ডস। পরে একই পথে হাঁটে বেলজিয়াম, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে কানাডা, ভারত, রাশিয়া। অস্ট্রিয়া এবং সুইডেন জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য থেকে তাদের দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। রোমানিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, বুলগেরিয়া এবং চেকপ্রজাতন্ত্রও ব্রিটিশ ফ্লাইটে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।বলা হচ্ছে, ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে করোনা ভাইরাসের এই নতুন মিউটেশনটির সন্ধান পাওয়া গেছে।তবে এটি যে আগের চাইতে সহজে মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে, গুরুতর অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে বা ভ্যাকসিনকে মোকাবিলা করতে পারে-এমন কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।তবে দুটি কারণে বিজ্ঞানীরা এই নতুন ‘স্ট্রেইন’টির ওপর কড়া নজর রাখছেন।একটি কারণ হলো: যে জায়গাগুলোতে সংক্রমণের সংখ্যা বেশি সেখানেই এই নতুন স্ট্রেইনটি পাওয়া গেছে।এদিকে ভাইরাসের মিউটেশনের কারণে টিকা কার্যকর হবে কিনা এ প্রশ্ন উঠছে অনেকের মনে
এটি একটি সতর্ক সংকেত। তবে একে ব্যাখ্যা করা সম্ভব দু’ভাবে।একটি হলো: করোনাভাইরাসের মধ্যে হয়তো এমন একটি মিউটেশন হয়েছে-যা আরো সহজে ছড়াতে পারে, এবং সেকারণেরই সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে।তবে এমনও হতে পারে যে এই নতুন স্ট্রেইনটি “সঠিক সময়ে সঠিক লোকদের” সংক্রমণ করেছিল।এটাকে বলা হচ্ছে স্প্যানিশ স্ট্রেইন।

ব্রিটেনের লোকেরা যখন আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে গ্রীষ্মের ছুটিতে স্পেনে বেড়াতে গিয়েছিল – তখন তারা এই বিশেষ মিউটেশনটিতে সংক্রমিত হয়েছে এবং এটাকে ব্রিটেনে নিয়ে এসেছে।তবে আসলেই এই স্ট্রেইনটি অন্যগুলোর চাইতে সহজে ছড়াতে পারে কিনা – তা নিশ্চিত হতে হলে ল্যাবরেটরিতে বেশ কিছু পরীক্ষা করে দেখতে হবে।যেটি গবেষকদের অবাক করেছে, তা হলো, এই ভাইরাসটি অনেক বেশি সহজে এবং দ্রুত ছড়াচ্ছে। আগেরটির তুলনায় এই নতুন করোনাভাইরাস ৭০ শতাংশ বেশি হারে ছড়াচ্ছে। ব্রিটিশ সরকারকে যে শুক্রবার আচমকা আবারও কঠোর লকডাউন জারি করতে হলো, তার পেছনে এটাই কারণ। এটি সরকারের মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি করেছে।সংস্থাটি বলছে, এ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক স্বীকার করেছেন যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল বলেই এই কঠোর বিধিনিষেধ জারি করতে হয়েছে।তিনি এমন ইঙ্গিতও দেন যে এবারের কঠোর লকডাউন দু‌’মাস ধরে চলতে পারে। ক্রিসমাসের মাত্র এক সপ্তাহ আগে নেয়া সরকারের এই পদক্ষেপ থেকে বোঝা যায়, সরকার পরিস্থিতিকে খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে করছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন মাত্র কয়েকদিন আগেই ক্রিসমাসের সময় বিধিনিষেধ শিথিল করার কথা বলছিলেন এবং তার কথা ছিল, এটা না করলে তা হবে অমানবিক।কিন্তু তিনদিনের মাথায়, তাকে সেই পরিকল্পনা শুধু বাদই দিতে হলো না, উল্টো আর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হলো।

গত বছরের শুরুতে যে ধরণের কঠোর লকডাউন ইউরোপে দেখা গিয়েছিল, এখন লন্ডন এবং আশেপাশের এলাকা আবার কার্যত সেরকম লকডাউনের আওতায় আসলো।গভর্ণমেন্ট ইকোনমিক ওয়াচডগ সুত্র অনুযায়ী ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইউকে বেকারত্ব ২মিলিয়ন বা ২০ লাখে পৌঁছাবে। এটি কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৭.৫ শতাংশ। ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, বেকারত্বের হার পরের বছরের এপ্রিল থেকে জুনে ৭.৭ শতাংশ শীর্ষে পৌঁছাবে।করোনা মহামারিতে লকডাউন ও বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠার পর কোনো একক বছরে এই প্রথম এত সংখ্যক মানুষের খাদ্য সহায়তা দিতে হচ্ছে ডব্লিউএফপিকে।এদিকে শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসের জন্য ব্রিটেনে টিকাদান কর্মসূচিতে প্রায় ১২ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় হবে। উৎপাদন, ক্রয় এবং বিতরণসহ টিকাদান কর্মসূচীর জন্য এই ব্যয় হবে। এ অবস্থায় সরকার বলছে, করোনা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলার জন্য এটি আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সরকার দেশের জনগণকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তবে করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে বৃটেনকে মুক্ত হতে এখনও অনেক সময় লাগবে বলেই মনে হচ্ছে।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট-raihan567@yahoo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *