বিশেষ প্রতিনিধিঃ মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বিপুল বিশ্বাস নামে এক নৈশপ্রহরীর তন্ত্রমন্ত্রে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতের ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই নৈশপ্রহরীর মাধ্যমে গত ২৩ জানুয়ারি শ্রীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষার দিন প্রধান শিক্ষক পদে অংশ নেয়া আতিকুর রহমান সোহেল নামের এক শিক্ষককে তাবিজ স্পর্শ করার কারণে তিনি মাটিতে লুঠে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। এর জের ধরে নিয়োগ পরীক্ষার পূর্বমুহুর্তে বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরীর এমন কর্মকান্ডে তাৎক্ষণিক দেখা দেয় চরম উত্তেজনা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের জন্য তাৎক্ষণিক নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি ও নিয়োগ বোর্ড। এ ঘটনায় পরদিন শিক্ষক সোহেলের বড়ভাই লুৎফুর রহমান বাদী হয়ে বিপুল বিশ্বাসকে আসামী করে থানায় মামলা দায়ের করেন। এদিকে শিক্ষক সোহেলের সাথে এমন আচরণের প্রতিবাদে স্থানীয় শ্রীপুর ও মহতোছিন আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়।
এ ঘটনার দুই দিন পর ২৫ জানুয়ারি বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন- বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য আসুক মিয়া, ছালিক উদ্দিন ও দিপু খান। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবার জন্য বলা হয়েছে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর ভাষ্য, প্রধান শিক্ষক পদে অংশ নেয়া আতিকুর রহমান সোহেলের প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর সাথে যোগসাজশ করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাবিজ দিয়ে নৈশপ্রহরী বিপুল শিক্ষক সোহেল যাতে নিয়োগ পরীক্ষায় স্বাভাবিকভাবে অংশ না নিতে পারে সে জন্য এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি সে ঘটিয়েছে। এছাড়া এরআগেও বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সাথে একাধিকবার তাবিজ স্পর্শ করিয়ে অজ্ঞান করার ঘটনায় নৈশপ্রহরী বিপুল বিশ্বাসকে কয়েকবার বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির লোকজনের মধ্যে মতানৈক্য থাকার কারণে তাকে আবারো স্বীয় পদে বহাল রাখা হয়।
আরো জানা যায়, গত ২৩ জানুয়ারি ছিল ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের শ্রীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পরীক্ষা। প্রধান শিক্ষক পদে ৫ জন প্রার্থী এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে ১০ জনের মধ্যে ৪ জন প্রার্থী নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন। নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ আনোয়ার, ডিজি প্রতিনিধি ফারুক আহমদ, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম খান বাচ্চু, সদস্য আব্দুল মন্নান ও বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবুল হাসান খান। নিয়োগ পরীক্ষার দিন পূর্ব মুহুর্তে বাঁধে মূল বিপত্তি। পরীক্ষার হলরুমে প্রবেশের মুহুর্তে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রধান শিক্ষক পদে আবেদনকারী আতিকুর রহমান সোহেল বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী স্থানীয় শ্রীপুর লামাপাড়া এলাকার বাসিন্দা বিপুল বিশ^াস (৪৮) কে কুশল জিজ্ঞেস করলে বিপুল বিশ^াস আশীর্বাদ দেয়ার কথা বলে একটি তাবিজ শিক্ষক সোহেলের শরীরে স্পর্শ করান। তখন শিক্ষক সোহেলের শরীরের কাঁপুনি শুরু হয় এবং নৈশপ্রহরী বিপুল ঘটনাস্থলেই প্রস্রাব করে দেন। এসময় শিক্ষক সোহেল অজ্ঞান হয়ে বিদ্যালয়ের বারান্দায় লুঠে পড়েন। বেঁধে যায় হুলুস্থুল কান্ড। বিদ্যালয়ের আশপাশের লোকজন এসে জড়ো হয়ে হট্টগোল শুরু করে নৈশপ্রহরী তান্ত্রিক বিপুল বিশ্বাসকে গণধোলাই দেয়। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরা পরিস্থিতি শান্ত রাখতে নৈশপ্রহরি বিপুল বিশ^াসকে একটি রুমে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে কুলাউড়া থানার অফিসার্স ইনচার্জ বিনয় ভূষন রায়সহ একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল বিশ^াসকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরা ও স্থানীয়রা শিক্ষক সোহেলকে উদ্ধার করে প্রথমে ব্রাহ্মণবাজারের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে এবং পরবর্তীতে তাকে সিলেট ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বর্তমানে ঢাকা স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানান তাঁর বড়ভাই শিক্ষক ফয়জুর রহমান ছুরুক।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবুল হাসান খান বলেন, নিয়োগ পরীক্ষার পূর্ব মুহুর্তে নিয়োগ বোর্ডের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে আমরা অফিস কক্ষে প্রশ্নপত্র প্রস্তুুত করছিলাম। এমন সময় শুনতে পাই বিদ্যালয়ের ফটকের বাইরে লোকজন উত্তেজনা ও হট্টগোল করছে। এসময় আমরা অফিস কক্ষ থেকে বের হয়ে শিক্ষক সোহেলকে অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখি। তখন শিক্ষক সোহেল আমাদের জানান, বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী বিপুল তাকে আশীর্বাদ করার কথা বলে তার মাথায় তাবিজ স্পর্শ করায়। তাৎক্ষণিক বিদ্যালয়ে জরুরী সভা করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়। এছাড়া অতীতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে খারাপ আচরণ করার কারণে বিপুল বিশ্বাসকে বরখাস্ত করা হয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের সাথে খারাপ আচরনের কারনে তাকে বরখাস্ত করা হয়নি বরং তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে কয়েকবার তাকে শোকজ করা হয়েছিল।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোঃ নুরুল ইসলাম খান বাচ্চু জানান, নিয়োগ পরীক্ষার দিন আমার সামনে এই ঘটনাটি ঘটে। প্রধান শিক্ষক পদে পরীক্ষা অংশ নেয়া শিক্ষক সোহেল আমাকে এসে মাথা ঘুরছে বলেই মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। এ বিষয়ে যেহেতু মামলা হয়েছে তা নিষ্পত্তির পর আবার নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
কুলাউড়া থানার অফিসার্স ইনর্চাজ বিনয় ভূষণ রায় বলেন, বিপুল বিশ্বাস বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে। তাকে রিমান্ডে আনার জন্য বিজ্ঞ আদালতের কাছে আবেদন করা হয়েছে। এছাড়া আলামত হিসেবে বিপুলের মোবাইল ফোন ও তাবিজটি পুলিশ জব্দ করেছে।