ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : সোমবার বিকালে নগরীর সিলভার সিটি এলাকায় সহপাঠীদের হাতে ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছে অশেষ কর নামের এক কিশোর। এলাকার প্রান্ত দাস ও হৃদয় পালের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের কিশোর তার ওপর প্রকাশ্যে হামলা চালায়। অশেষ কর ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় এলাকায় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠা কিশোরদের নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। একই দিন সন্ধ্যায় শহরতলীর কামাল বাজারে বাড়ি থেকে আরেক কিশোরকে অপহরণ করতে গিয়ে ডাকাত সন্দেহে এলাকার মানুষের হাতে আটক হয়েছে ১৬ জন। তারা সবাই স্কুল-কলেজপড়ুয়া কিশোর ও তরুণ। আটক হওয়া ওই কিশোরদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে পুলিশ এলাকার জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের জিম্মায় তাদের ছেড়ে দিয়েছে। ওদের ‘কিশোর গ্যাং’ মানতে নারাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
কারণ ওদের অতীত অপরাধের কোনো রেকর্ড নেই। কিন্তু সিলেটে সংঘবদ্ধ থাকা কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। সিলেট নগরীর প্রায় সব এলাকায় কিশোররা আড্ডা দেয়া ছাড়াও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ওদের বাইরেও নগরে কয়েকটি ‘কিশোর গ্যাং’ নানা অপরাধে সক্রিয় রয়েছে। বড় ধরনের ঘটনায় ওই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নাম উঠে না আসলেও এলাকাভিত্তিক ছিনতাই, মাদক বিক্রি ও সেবন, তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা সহ নানা অপরাধে জড়িত। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দক্ষিণ সুরমার কামালবাজার ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে মোবাইলফোনে দুই কিশোরের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এ ঘটনার জের ধরে আটক হওয়া ১৬ কিশোর পরিকল্পনা করে তওফিকুল ইসলাম তাইম নামের প্রতিপক্ষ কিশোরকে অপহরণ করবে। পরিকল্পনা মতো কামালবাজার এলাকার নভাগী গ্রামে যায় ১৬ জন কিশোর। তাইমদের বাড়িতে যাওয়া মাত্রই ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয়রা তাদেরকে আটক করে দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। মধ্যরাতে থানায় উভয় পক্ষের মধ্যে বৈঠক শেষে পুলিশ আটককৃতদের কাছ থেকে মুচলেকা রেখে অভিভাবকদের জিম্মায় ছেড়ে দেয়। পুলিশ জানায়, আটক হওয়া ১৬ কিশোর কোনো গ্যাংয়ের সদস্য না। তারা ফুটবল খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। অভিভাবকদের ডেকে এনে সতর্ক করে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। কারণ আটককৃত সব কিশোরই হচ্ছে স্কুল-কলেজের পড়ুয়া। এদিকে পুলিশের এমন সিদ্ধান্তকে স্থানীয়রা ইতিবাচক হিসেবে নিলেও কিশোরদের কর্মকাণ্ডে তারা চিন্তিত। তারা জানিয়েছেন, একজনকে অপহরণ করতে ১৬ জন কিশোর সংঘবদ্ধভাবে রাতের আঁধারে আসা ভয়ঙ্কর বিষয়। রাতের বেলা ডাকাত সন্দেহে তাদের গণপিটুনি দিতে পারতো। সিলেট পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘এ ধরনের অপরাধই হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের ‘গেটওয়ে’। তারা প্রথমে সংঘবদ্ধভাবে আড্ডা দেয়। প্রযুক্তির যুগে তারাও নানা অপরাধ ইউটিউব সহ ভার্চ্যুয়াল মাধ্যম থেকে শিখে যায়। অপহরণের চিন্তা নিয়ে এক স্থান থেকে তারা অন্য স্থানে গিয়েছিল। অভিভাবকদের এখনই সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে স্কুলপড়ুয়া ছেলেদের সংঘবদ্ধ আড্ডার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’ সিলেটে সংঘবদ্ধ কয়েকটি কিশোর গ্রুপ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। পেশাদার মাদক বিক্রেতারা মাদক বিক্রিতে ওই কিশোর গ্যাংদের ব্যবহার করে থাকে। তারা মাদকও সেবন করে। নগরীর দক্ষিণ সুরমার কদমতলী, টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন, স্টেশন রোড, বন্দরবাজার, টুকেরবাজার সহ কয়েকটি এলাকায় এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দাপট দেখাচ্ছে। তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড আঁতকে উঠার মতো। ভোর হলেই দূর-দূরান্ত থেকে সিলেট নগরী থেকে আসতে থাকে পণ্যবাহী গাড়ি। এর মধ্যে রয়েছে মাছ, সবজি, পিয়াজ, চাল সহ নানা পণ্য। এসব পণ্যবাহী গাড়ি টার্গেট করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তারা দক্ষিণ সুরমা ও সুনামগঞ্জ বাইপাসের স্পিডব্রেকার থেকে গাড়িতে উঠে যায়। এরপর ব্লেড বা চাকু দিয়ে ত্রিপল (পণ্য ঢাকার কাপড়) কেটে গাড়ি থেকে পণ্য সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়। এ নিয়ে রীতিমতো বিরক্ত নগরীর কাজিরবাজারের মৎস্য আড়তদার ও সুবহানীঘাটের সবজি আড়তদাররা। কয়েক মাস আগে এসব কিশোর গ্যাংদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করেছিলেন। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পুলিশের কাছে আবেদন জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি। বরং সাম্প্রতিক সময়ে আরো বেড়েছে ওইসব কিশোর গ্যাংদের কর্মকাণ্ড। নগরীর বন্দরবাজার এলাকায় মাদকসেবী কিশোর গ্যাংদের দৌরাত্ম্য বহুদিনের। ওই গ্যাংয়ের অনেকেই বন্দরবাজার এলাকায় লুকিয়ে ফেরি করে মাদক বিক্রি করে। আবার কেউ কেউ মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনতাইয়ে জড়িত। রাত হলে নগরীর কীন ব্রিজের নিচ কিংবা বিভিন্ন মার্কেটের সামনে তারা অবস্থান নেয়। এসব কিশোর গ্যাংদের উৎপাতে ব্যবসায়ীরাও থাকেন আতঙ্কে। কারণ তাদের হামলায় প্রায় সময় ভুক্তভোগীরা আহতও হন। সিলেট নগরীর আম্বরখানা, সাপ্লাই, শাহী ঈদগাহ, টিবি গেইট ও টিলাগড় এলাকায়ও এমন একটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। শিবগঞ্জ, শাহজালাল উপশহর ও রোজভিউর সামনে পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সরব। উপশহরে গত দুই বছরে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, হামলার ঘটনায় কয়েকটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি হয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। নগরীর মেডিকেল এলাকার (নবাব রোডের মুখ) একটি কিশোর গ্যাং এলাকার সবার কাছে পরিচিত। কয়েক মাস আগে ওই গ্যাংয়ের সদস্যরা দুই কিশোরকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছিলো। বাগবাড়ি ও কানিশাইল এলাকায়ও কিশোর গ্যাং রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মো. আশরাফ উল্লাহ তাহের জানিয়েছেন, দক্ষিণ সুরমায় আটক হওয়া ১৬ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ছিল না। তারা স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছাত্র। এ কারণে অভিভাবকদের সতর্ক করে দিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সিলেটে অপরাধে জড়িত কিশোর গ্যাংদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। অপরাধে যারাই জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।