ভারত থেকে তিন বছর পর এক হাত, এক কান ছাড়া ফিরলেন কুলাউড়ার শাহাজান

মাহফুজ শাকিল : তিন বছর আগে ওরস মাহফিলে যাওয়ার কথা বলে নিখোঁজ হন শাহাজান মিয়া (২৩)। স্বজনরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে তার কোনো হদিস পাচ্ছিল না। পরিবারের সবাই শাহাজানের আশা যখন ছেড়েই দিয়েছিলো তখন তিন বছর পর এক হাত, এক কান ছাড়া ভারত থেকে ফিরে এসে শাহাজান জানায় তাঁর বেঁচে থাকার লোমহর্ষক ঘটনা। আপন মামারা তাকে তার হাত, কান ও মাথার একাংশ কেটে মৃত ভেবে ভারতীয় সীমান্তে ফেলে চলে যায়।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কুলাউড়ার চাতলাপুর সীমান্ত থেকে হাত, কান এবং মাথার একাংশ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় শাহাজানকে উদ্ধার করে ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাশহর হাসপাতালে পাঠায়। সেখান থেকে আগরতলা মর্ডাণ সাইক্রিয়াটিক হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেসে নিয়ে দু’দেশের হাইকমিশনের সহযোগিতায় ছয়জন প্রতিবন্ধীদের সাথে গত বৃহস্পতিবার (১৮ নভেম্বর) দুপুরে এক হাত ও এক কান কাটা অবস্থায় শাহাজানকে ফিরে পায় তার পরিবার।

বৃহস্পতিবার দুপুরে আখাউড়া-আগরতলা সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরাস্থ আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনার ও আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাজানকে তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। ওইদিন সকাল থেকেই ত্রিপুরা সীমান্তের এপারে আখাউড়া ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন নিখোঁজ শাহাজানের স্বজনরা। অপেক্ষার প্রহর শেষে ঠিক দুপুর ১টার দিকে ভারতের ত্রিপুরাস্থ আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনার জোবায়েদ হোসেন এক এক করে ৬জন বাংলাদেশিদের আখাউড়া-আগরতলা নো-ম্যান্স ল্যান্ডে নিয়ে আসেন। আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোমানা আক্তারের মাধ্যমে নিজ পরিবারের কাছে শাহজাহানসহ অন্য পাঁচজনকে তাদের স্বজনদের তুলে দেন তিনি। এসময় নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ভারতের ত্রিপুরাস্থ বাংলাদেশ সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ জোবায়েদ হোসেন ছাড়াও সহকারী হাইকমিশনের প্রথম সচিব মো. রেজাউল হক চৌধুরী, কমিশনের এস এম আসাদুজ্জামান (প্রথম সচিব, স্থানীয়), বিএসএফ আগরতলা কোম্পানি কমান্ডার রাজকুমার, বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুমানা আক্তারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। দেশে ফিরলেও শাহাজান বর্তমানে তার মামাদের হুমকির ভয়ে সে ফুফু রুপজান বিবির বাড়িতে বসবাস করছে।

কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের ডরিতাজপুর গ্রামের মানিক মিয়ার ছেলে শাহাজাহান। পেশায় একজন কৃষক। তিন বছর আগে আপন মামাদের সাথে তাঁর পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ চলে।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শাহাজান বাদী হয়ে গত ২২ নভেম্বর মৌলভীবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৫নং আমলী আদালতে তার ৪ মামাকে আসামী করে মামলা (নং- ৪৩৬/২১ ইং) দায়ের করেন। আসামীরা হলেন শাহাজানের মামা ওয়াছির মিয়া (৩৮), ফুরকান মিয়া (৩২), মবশি^র মিয়া (৪৫), ইয়াছিন মিয়া (২৫) ও সিএনজি চালককে অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়। মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

মামলার এজাহার সূত্রে ও সরেজমিন শাহাজানের ফুফুর বাড়িতে গেলে জানা যায়, টিলাগাঁও ইউনিয়নের ডরিতাজপুর গ্রামের বাসিন্দা মানিক মিয়ার সাথে তার স্ত্রীর পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিরোধের কারণে মানিক মিয়ার স্ত্রী স্বামীর সাথে খারাপ আচরণ করতে থাকেন। তখন মানিক মিয়ার ছেলে শাহাজান মিয়া তার পিতার পক্ষ নিয়ে তার মাতাকে বুঝানোর চেষ্টা করে। সেই কারণে শাহাজানের মামা ওয়াছির মিয়া, ফুরকান মিয়া, মবশি^র মিয়া, ইয়াছিন মিয়া তার ওপর তেলেবেগুনে জ¦লে উঠেন। তখন আক্রোশ^ান্মিত হয়ে শাহাজানের মামারা তাকে বিভিন্ন ধরণের ভয়ভীতি দেখিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করার হুমকি প্রদান করেন। কিন্তু শাহাজান তার পিতার পক্ষ নিয়ে কথা বললে তার মামারা তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ঘটনার দিন ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি টিলাগাঁও ইউনিয়নের কামালপুরে হযরত শাহ ফয়জুল হক চিশতীর মাজারে একটি উরুস মাহফিলে যায় শাহাজান। সেখান থেকে রাত ২টার সময় শাহাজানের মামা ইয়াছির মিয়া গোপন কথা আছে বলে তাকে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা একটি সিএনজি অটোরিকশায় তার অন্য মামাদের সহযোগিতায় জোরপূর্বক সিএনজিতে তুলে। তারপর শাহজানের মামার ধারালো অস্ত্র দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। ওই সময় তার মামা ফুরকান মিয়া তার হাতে থাকা দা (বটি) দিয়ে শাহাজানের গলা বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে কুপ দিলে শাহাজান একটু কাথ হলে সেই কুপ তার ডান কাধে পড়ে ডান হাতের গোড়া থেকে হাতটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর মামা ওয়াছির মিয়া তার হাতে থাকা খাসিয়া দা দিয়ে শাহাজানের মাথা লক্ষ্য করে ছেদ মারলে সেই ছেদ মাথার বামপামে পড়লে মাথার বামপাশের কিয়দংশসহ বাম কান শরীর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মামার মবশি^র মিয়া তার হাতে থাকা ছুরি দিয়ে শাহাজানের বুকে ২টি কুপ মারলে সেই কুপ বুকের নীচে পড়ে মারাত্মক জখম হয়। এরপর মামার ইয়াছিন মিয়া তার হাতে থাকা ছুরি দিয়ে শাহাজানের বাম হাতে পর পর ২টি কুপ দিলে হাতের বিভিন্ন জায়গায় গুরুত্বর জখম হয়। লোমহর্ষক হামলার পর শাহাজানের মামারা তাকে মৃত ভেবে শরীফপুর ইউনিয়নের চাতলাপুর সীমান্তে কাঁটাতারের ভিতরে ভারতের অংশ রেখে চলে আসে। পরবর্তীতে বিএসএফ ওইদিন সকালে সীমান্ত এলাকায় টহলরত অবস্থায় শাহাজানকে দেখতে পেয়ে তাকে উদ্ধার করে কৈলাশহর হাসপাতালে ভর্তি করে। প্রায় বছর খানেক কৈলাশহর হাসপাতালের আইসিউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে শাহাজান। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় মর্ডাণ সাইক্রিয়াটিক হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সেখানে ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিল শাহাজান।

হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় একপর্যায়ে জ্ঞান ফিরে শাহাজানের। সেখানে হাসপাতালের এক নার্সের মাধ্যমে কিছু ঘটনার বিষয়ে জানতে পারে শাহাজান। পরে নার্সের মাধ্যমে দেশের বাড়ীতে যোগাযোগ করলে পরবর্তীতে ভারতীয় হাইকমিশনের সাথে বাংলাদেশ সহকারী হাই কমিশন আগরতলা ত্রিপুরা ২২ অক্টোবর শাহাজানকে দেশে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরপর ১৮ নভেম্বর সে দু’দেশের সহযোগিতায় সে দেশে ফিরে। দেশে ফিরে সে চার মামাকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলা দায়ের করে। মামলা করার পরও ক্ষান্ত হয়নি শাহাজানের মামারা। মামলা তুলে নেয়ার জন্য বিভিন্ন ধরণের হুমকি প্রদান করে।

ভুক্তভোগী শাহাজান অভিযোগ করে বলেন, পারিবারিক অনেক বিষয় নিয়ে আমার বাবা ও মায়ের প্রায়শই ঝগড়া হতো। আমি বাবার পক্ষ নিয়ে কথা বলায় আমার মামারা আমার ওপর রাগান্বিত হন। সেই আক্রোশের জেরে মামা ফুরকান এর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ মুখোশধারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে আমাকে চাতলাপুর সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়ার সামনে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ফেলে রেখে যান। পরে বিএসএফ আমাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করে। সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে শাহাজান জীবনে বিভীষিকাময় ঘটনা তুলে ধরেন কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদকের কাছে। তিনি জানান প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনার কাহিনী। এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায় সে ও তাঁর স্বজনরা। শাহাজানের মামারা প্রকাশ্য বাড়িতে থেকে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। আমি বাবাকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করতাম। এখন আমার এক হাত ও এক কান নেই। আমি কিভাবে আমার বাকি জীবনটা পরিচালনা করবো। সেই চিন্তা এখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার জীবনে চরম দূর্বিসহ নেমে এসেছে।

শাহাজানের ফুফু রুপজান বিবি বলেন, শাহাজান খুবই শান্ত ও সহজ সরল প্রকৃতির ছেলে। পরিবারে ৪ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। দেড় বছর আমরা তাকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছি। পরে জানতে পারি সে ভারতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। শাহাজানের মামারা বিরোধের জেরে থাকে অপহরণ করে নিয়ে মারধর করে সীমান্তে ফেলে আসে। তিন বছর পর সরকারের মাধ্যমে তাকে দেশে আনা হয়েছে। এখন সে তার মামাদের ভয়ে আমার বাড়িতে রয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

শাহাজানের মামাতো ভাই সমাজকর্মী ও ছাত্রলীগ নেতা এস এম লুৎফুর রহমান বলেন, অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন জানতে পারি সে ভারতে রয়েছে তখন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য গত ৬ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে আবেদন করি। এরপর দু’দুশের হাইকমিশনের মাধ্যমে গত ১৮ নভেম্বর শাহাজানকে দেশে আনা হয়। দেশে ফিরলেও এখন সে তার মামাদের দ্বারা বিভিন্ন হুমকি-ধামকি ও আতঙ্কে রয়েছে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন হয় এমন দাবি জানাচ্ছি।

শাহাজানের বাবা মানিক মিয়া বলেন, তার ছেলে সুস্থ, সবলভাবে ওয়াজ মাহফিলে যাওয়ার কথা বলে তিন বছর আগে বাড়ি থেকে বের হয়। দেড় বছর পর স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে জানতে পারি ছেলে ভারতে আছে। এখন সে সরকারের সহযোগিতায় দেশে ফিরেছে। আমার ছেলে ভয়ে বাড়িতে আসতে চায়নি, তাকে আমার বোনের বাড়িতে রেখেছি। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ন্যায়বিচার দাবি করছি।

শাহাজানের মামা ওয়াছির মিয়া তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শাহাজান একজন মানসিক ভারসাম্য হীন। ভারসাম্যহীন অবস্থায় পরিবারের সবার অগোচরে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় গেছে সেটা আমরা জানিনা। আমরা কেন তাকে মারতে যাবো, তৃতীয় পক্ষ হয়তো কেউ আমাদের ফাঁসাতে এমন ষড়যন্ত্র করছে। প্রশাসন তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনার রহস্য উন্মোচন করবে।

এ ব্যাপারে কুলাউড়া থানার অফিসার্স ইনর্চাজ বিনয় ভূষণ রায় বলেন, আমার কাছে আসলে বিজ্ঞ আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেই। আদালত থেকে নির্দেশনা আসলে আমরা প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোঃ আবু ইউসুফ এই প্রতিবেদককে বলেন, এ ঘটনায় বিজ্ঞ আদালত থেকে এখনো মামলার কোন কাগজাদি আসেনি। আসলে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

এ ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলনা। আপনাদের মাধ্যমে বিষয়টি জানলাম। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শাহাজানকে সবধরণের আইনী সহযোগিতা করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *