মাহফুজ শাকিল : আজ ৬ ডিসেম্বর সোমবার কুলাউড়া শত্রু মুক্ত দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধে কুলাউড়া উপজেলার রয়েছে এক গৌরবময় ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যখন সমগ্র দেশে বিজয় উৎসব ধ্বনিত হয় ঠিক তার পূর্বে ৬ ডিসেম্বর কুলাউড়া উপজেলা সম্পূর্ণরুপে শত্রু মুক্ত হয়। এরপর থেকে দিনটিকে কুলাউড়াবাসী শত্রু মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
বিজয়ের ৫০ বছর অতিবাহিত হলেও কুলাউড়া উপজেলার যেসব স্থানে বধ্যভূমি রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বধ্য ভূমিগুলো। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় কুলাউড়া ডাক বাংলো মাঠে নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর পূর্ব পাকিস্তানের চেহারা পাল্টে যায়। সারাদেশ জুড়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। ঠিক ঐ সময়ে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রামে কুলাউড়ার দেশপ্রেমিক মুক্তিকামী বীর সন্তানেরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৭ মে পর্যন্ত বৃহত্তর সিলেট জেলায় অনুষ্ঠিত প্রতিরোধ যুদ্ধে সরাসরি সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিলেন কুলাউড়ার অকুতোভয় কয়েকজন সৈনিক। তারা হলেন তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ব্যারিস্টার আব্দুল মোন্তাকিম চৌধুরী, সাবেক এমপি মরহুম আব্দুল জব্বার, আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল আবেদীন, আব্দুল মুক্তাদির চৌধুরী জুবেদ, আব্দুল লতিফ খাঁন, মুকিম উদ্দিন খাঁন, মিয়া ঠাকুর, ন্যাপের নবাব আলী সফদর খাঁন রাজা, নবাব আলী সরওয়ার খান চুন্নু, লুৎফুর রহমান চৌধুরী হেলাল, আওয়ামী লীগের মমরুজ বখ্শ মটু, আছকির আলী, সৈয়দ জামাল, আব্দুল মনাফ প্রমুখ।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই উপজেলায় সর্বমোট ৫৯২ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের মিনারা বেগম নামে একজন বীরাঙ্গনা রয়েছেন। এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কুলাউড়া উপজেলার ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও ছাত্র, যুবক, কৃষকসহ প্রায় ৪৫০ জনকে হত্যা করা হয়।
কুলাউড়ায় পাক বাহিনীর প্রবেশ ও নির্মম গণহত্যা ঃ সারা বাংলায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা অত্যাচার নিপীড়ন শুরু করলেও কুলাউড়া থানায় তারা প্রথম আসে ৭ মে ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানি সৈন্যেরা মৌলভীবাজার থেকে কুলাউড়া প্রবেশ পথে কাপুয়া ব্রিজের কাছাকাছি আসলে তাদের গতিরোধ করতে অকুতোভয় বীর সৈনিক জয়চন্ডী ইউনিয়নের মোঃ আকরাম ওরফে আছকির মিয়া ও হাবিব উদ্দিন একটি গাড়ি নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে যান। গাড়ি চালাচ্ছিলেন হাবিব উদ্দিন। তখন আছকির মিয়া পাকিস্তানিদের দেখে প্রথমে তার ডান হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যেদের গাড়িতে গুলি ছুঁড়েন। পাকিস্তানি সৈন্যেরা তাদের গাড়ির উপর রাখা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এলএমজি দিয়ে পাল্টা গুলি ছুঁড়ে। তারা দুজনে গাড়ি নিয়ে ঘুরিয়ে আসার সময় কাপুয়া ব্রিজের সামনে গাড়িটি উল্টে যায়। ঘটনাস্থলে আছকির মিয়া শহীদ হন। আর হাবিব উদ্দিন ফিরে আসার চেষ্টা করলেও গাজিপুরে এসে মৃত্যুবরণ করে শহীদ হন। এই দুই বীর সন্তান হলেন কুলাউড়ায় স্বাধীনতা মুক্তিসংগ্রামের প্রথম শহীদ। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের সহায়তায় নিধনযজ্ঞ অব্যাহত রাখে। ৫ এপ্রিল কুলাউড়া থানার জয়চন্ডী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাজাকারদের সহযোগিতায় ২৪ মে পাকিস্তানি সেনারা ২২ জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে ও ১৪ জুন মীরবক্সপুর গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে একই গ্রামে গিয়ে নিধন যজ্ঞ চালায়।
পাক বাহিনীর ক্যাম্প তৈরি ঃ তৎকালীন সময়ে কুলাউড়াতে পাকিস্তানের ২২ বালুদ রেজিমেন্টের অধীনে ছিল। তারা তিনটি ক্যাম্প তৈরি করেছিল। কুলাউড়া থানা হাসপাতাল, কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও এনসি স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করেছিলো। একটি রেজিমেন্টে সাধারণত ৭০০-৮০০ সৈনিক থাকে। ২২ বালুদ রেজিমেন্টে সহায়তার জন্য প্যারামিলিটারির দুটি প্লাটুন ছিল। এসব ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তানি মেজর ওয়াহিদ মোগল ও ক্যাপ্টেন দাউদ। ওয়াহিদ মোগল এনসি স্কুলে থাকতেন বলে শোনা যায়। তৎকালীন মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ইউসুফ মুক্তার ও নবাব আলী ইয়াওর খান পাকিস্তানিদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। পাকিস্তানি সৈন্যের আগমনে স্বাধীনতা বিরোধীরা শান্তি কমিটি, আলবদল, রাজাকার, আল-সামস কমিটি গঠন করে বাঙালি নিধন যজ্ঞ চালায়।
যেসব স্থানে অপারেশন চালায় ঃ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধারা যেসব স্থানে অপারেশন চালায় এর মধ্যে উপজেলার দত্তগাঁও, চাতলাপুর চা বাগান, চাতলাপুর আলীনগর ফাঁড়ি, পাইকপাড়া, মনু রেল স্টেশন, পৃথিমপাশা, বরমচাল, মনু রেলস্টেশন লাইন কর্মধা এলাকা উল্লেখযোগ্য। নভেম্বর শেষপ্রান্তে এবং ডিসেম্বর প্রথম দিকে ভারত ও বাংলাদেশ চুক্তি হওয়াতে যৌথ মিত্র বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লে যুদ্ধের গতি তীব্রভাবে বেড়ে যায়। থানার সবচেয়ে বড় ও সর্বশেষ অপারেশন হয় গাজীপুর চা বাগানে। উক্ত চা বাগানে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। নেতৃত্বে ছিলেন মেজর আব্দুল ওয়াহিদ মোগল। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য বাগানে অবস্থান করছিল। অপরদিকে গাজীপুরের বিপরীতে চোঙ্গা বাড়ি। সেখানে মুক্তি বাহিনী ক্যাম্প ছিল।
যে ভাবে শত্রু মুক্ত হয় কুলাউড়া উপজেলা ঃ ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে গাজীপুর মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ৩০ নভেম্বর কাকুরা চা বাগানে অবস্থানকারী ৭৫ জন রাজাকার ও ৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য ধরা পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৮ম মাউন্টেন ডিভিশনের ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগিডে ভারতীয় জেনারেল কৃষ্ণ রায়ের অধীনে মূলত জুড়ীর ফুলতলা সাগরনাল হয়ে গাজিপুর এবং কুলাউড়া অক্ষে আক্রমণ পরিচালনা করে। অপরদিকে ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড চাতলা বিওপি হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। ৪ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর সি আর দত্তের অধীনস্থ কৈলাশহর সাব সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জামানের অধীনে নমুজা, হাজিপুর, শমসেরনগর হয়ে অগ্রাভিযান পরিচালনা করা হয়। তখন জেনারেল কৃষ্ণ রায়ের সাথে শমসেরনগর ডাকবাংলোতে ব্যারিস্টার আব্দুল মোন্তাকিম চৌধুরী বৈঠক করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ কুলাউড়ার গাজিপুরে পরিচালনা করা হয়। গাজীপুর এসে প্রথমে বড় বাধার সম্মুখীন হয় যৌথবাহিনী। ১ ডিসেম্বর কাকুরা চা বাগান থেকে গাজীপুর চা বাগান এলাকার দিকে মিত্র বাহিনীরা অগ্রসর হলে পাক সেনাদের সাথে পাল্টা গুলি বর্ষণ চলতে থাকে। ২ ডিসেম্বর রাতে যুদ্ধ হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে ৬ রাজপুত রেজিমেন্ট আক্রমণ করে পাকিস্তানিরা প্রচন্ড বাঁধার মুখে পড়ে অবস্থান দখল করতে ব্যর্থ হয়। তাদের অধিনায়ক মৃত্যুবরণ করে এবং বেশ কয়েকজন সৈন্যে নিহত হয়। তারপর ৪ ডিসেম্বর রাতে ৪-৫ গোর্খা রেজিমেন্টের লেফট্যানেন্ট কর্নেল এ বি হারলিকার নেতৃত্বে আক্রমণ করে ভারতীয় বাহিনী। প্রচন্ড যুদ্ধের পর পাকিন্তানিরা ব্যর্থ হয়ে অবস্থান ত্যাগ করে। তখন জানা যায়, পাকিস্তানিদের ৩০ জন সৈন্যে নিহত হয় এবং ৪০ জন আহত হয়। ১৫ জন সৈন্যের লাশ তারা গাজিপুরে ফেলে রেখে যায় আর বাকি ১৫ জন সৈন্যের লাশ তাদের সাথে নিয়ে যায়। ঐ দিনই সন্ধ্যার দিকে সম্মিলিত বাহিনী কুলাউড়ায় পৌঁছে ব্রাহ্মণবাজার হয়ে সিলেটের দিকে সড়কপথে পাকিস্তানিরা পলায়ন করে। অবশেষে এভাবেই ৬ ডিসেম্বর কুলাউড়া শত্রুমুক্ত হয়।
যে স্থানে রয়েছে বধ্যভূমি ঃ স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক সেনারা সমগ্র উপজেলাব্যাপী নির্মম হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে শহরের চাতলগাঁও কবরস্থান, কুলাউড়া নবীন সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী রেল গেইটের পূর্ব পার্শ্বে একটি ও দক্ষিণ পার্শ্বে গণকবর, রেলস্টেশনের আউটার সংলগ্ন স্থানে গণকবর, জয়চন্ডীর কামারকান্দিতে গণশহীদ, উত্তর জয়পাশা এলাকা ছাড়াও পৃথিমপাশা আলী আমজদ উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্মুখ স্থান পদ্ম দীঘির পার, দক্ষিণ রবিরবাজারস্থ হাসপাতালের দক্ষিণ পাশের্^র পুকুর পার, সীমান্তবর্তী এলাকা শরীফপুর ইউনিয়নের নমুজা, মনু স্টেশনে নদীর তীরবর্তী স্থানে গণশহীদদের গণকবর দেয়। এসব স্থানগুলো আজও সংরক্ষণ করা হয়নি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে এসব বধ্যভূমি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল গফুর বলেন, রবিরবাজারের এই বধ্যভূমিতে যুদ্ধকালীন সময়ে পৃথিমপাশার অক্ষয় দেব ও কৃতিময় দেব নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। এটি সংরক্ষণের জন্য বার বার আন্দোলন, সংগ্রাম করলেও আজোও তা রক্ষিত হয়নি। জায়গাটি রয়েছে অবৈধ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মেজর (অব.) নুরুল মান্নান চৌধুরী তারাজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার জন্য আমাদের আরো গবেষণা প্রয়োজন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের ভিত্তিপ্রস্থর রচনা করেছে। তাই তরুণ প্রজন্মকে অনুরোধ করবো শিখরের সন্ধানে যাতে তারা আরো পড়াশোনা করে এবং সঠিক ইতিহাস জানার চেষ্ঠায় ব্রতী হয়।
কুলাউড়া উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুশীল চন্দ্র দে শত্রু মুক্তির স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, সেই দিনের পৈশাচিকতা এখনো স্মৃতিতে ভয়াল রুপ নিয়ে ফিরে আসে প্রতি বছর। কারণ এই দেশটির স্বাধীনতা রক্ষায় পাক হানাদার মুক্ত করতে এই শহীদরা আত্মোহনন করেছিলেন। পাকিস্তানিদের পাশবিক নির্যাতনে মুক্তিকামীরা পানি খাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিল। তখন পাকিস্তানিরা প্র¯্রাব করে তাদেরকে খাইয়েছিল। গণশহীদদের কবরের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় তীব ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। তিনি এ বিজয়ের মাসে উপজেলার সকল বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানান।
অরক্ষিত বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম সফি আহমদ সলমান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, উপজেলা প্রশাসন থেকে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বসহকারে আলোচনা হয়েছে। কুলাউড়ায় যেসব স্থানে বধ্যভূমি রয়েছে সেগুলো আমরা চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছি। এরমধ্যে রবিরবাজারের বধ্যভূমিটি আমরা কয়েকদিন আগে সরেজমিন দেখে এসেছি। এটির টেন্ডার হয়ে গেছে, খুব শীঘ্রই ওই বধ্যভূমিতে স্মৃতি ফলক কাজ শুরু হবে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে বাকি বধ্যভূমিগুলোতে শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি করে স্মৃতি ফলক তৈরি করা হবে।