মৌলভীবাজারে শেষ মুহুর্তে জমে উঠেছে ঈদ বাজার

মাহফুজ শাকিল : ঈদের আর মাত্র দু’দিন বাকি। প্রবাসী অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলায় শেষ মুহুর্তে জমে উঠেছে ঈদ বাজার। প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন দোকানে পছন্দের কাপড় ক্রয় করতে ভীড় জমাচ্ছেন ক্রেতারা। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে গত দুই বছর ঈদে ব্যবসায় বেশ স্থবিরতা থাকায় ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। তবে এবার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় গত দুই বছরের ক্ষতি কাটিয়ে এবারের ঈদে ব্যবসায়ীরা প্রাণপ্রণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ঈদের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই অভিজাত মার্কেট থেকে শুরু করে ফুটপাতের দোকানগুলোতে বেচাকেনার ধুম লেগেছে। সবমিলিয়ে জমে উঠেছে মৌলভীবাজারের ঈদ বাজার। তাছাড়া ব্যস্ততা বেড়েছে দর্জিপাড়ায়ও। ক্রেতা সামাল দিতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তবে অনেক ব্যবসায়ী দাবি করলেন, করোনার গত দুই বছর ছাড়াও অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ব্যবসার আশানুরুপ কম হয়েছে। কারণ ক্রেতাদের কাছে টাকা কম।

চা-বাগান, হাওর, বাওড়, পাহাড়, টিলা ও প্রবাসী অধ্যুষিত মৌলভীবাজারে কয়েক লাখ মানুষ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন। প্রতিবছর তারা ঈদের আগ মুহুর্তে দেশে আসেন পরিবারের স্বজনদের সাথে একসাথে ঈদ উদ্যাপন করতে। কিন্তু সরকার করোনার নিষেধাজ্ঞা তুলায় অনেক প্রবাসী রমজান মাসের আগেই দেশে এসে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদের কেনাকাটা শেষ করেছেন। তবে এখনো মধ্যপ্রাচ্যর অনেক প্রবাসী দেশে এসে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কেনাকাটা করছেন।

সরেজমিনে ঈদের বিভিন্ন মার্কেট গুলো ঘুরে দেখা গেছে, পছন্দের কাপড় কেনাকাটায় অভিজাত শপিংমল, বিপণিবিতান ও দেশী-বিদেশী পোশাকের পাইকারি মার্কেট গুলোতে ভীড় করছেন তরুণ-তরুণী, ছোট-বড় সব বয়সী নারী-পুরুষরা। দোকানগুলোতে শোভা পাচ্ছে সাজানো নামীদামি ব্র্যান্ড ও বিদেশী পোশাকের পসরা। ফ্যাশনের বৈচিত্র্যের পাশাপাশি ক্রেতাদের মনোযোগ কাড়তে দোকানের সাজসজ্জাতেও এসেছে নান্দনিক পরিবর্তন। আবার ক্রেতা টানতে র‌্যাফেল ড্র কিংবা বিশেষ ছাড়ের আয়োজন রেখেছেন অনেক দোকানী। দূর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণে সাইনবোর্ডও নতুন করে লাগিয়েছেন কেউ কেউ।

জেলা শহরের অভিজাত মার্কেট গুলোর মধ্যে অন্যতম এমবি ক্লথ স্টোর, বিলাশ ডিপাটমের্ন্টাল স্টোর, আল মদিনা ক্লথ স্টোর, আশরাফ সেন্টার, জুলিয়া শপিং সিটি, সেরা টাউন ফ্লাজা, সেভেন স্টার, আর,কে কমপ্লেক্সসহ কুলাউড়ার সর্ববৃহৎ মার্কেট মিলিপ্লাজা, আর এম সিটিসহ অন্যান্য শপিং সেন্টারসহ ফুটপাতগুলোতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। অভিজাত বিপনী বিতানগুলির পাশাপাশি নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য ফুটপাতের দোকানগুলোতে বিভিন্ন ডিজাইনের কাপড় সাজিয়ে রেখেছেন হকাররা। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আসায় কাপড়ের দাম বেশি হাঁকাচ্ছেন।

ঈদ বাজারে তরুণীদের পছন্দের কাপড় সারারা, গারারা, থ্রি পিস, সেলোয়ার-কামিজ, সিঙ্গেল পিছ গ্রাউন স্কার্ট- ট্রপসের চাহিদা এবারো বেশি। প্রতিটি সারারা-গারারার দাম পড়েছে ১৫০০ টাকা থেকে ১৫০০০ হাজার টাকা। ছেলেদের জন্য লং ও শর্ট পাঞ্জাবি, ফতোয়া, শার্ট, জিন্স প্যান্ট, টি-শার্টসহ বাচ্চাদের নানা রঙ্গ ও ডিজাইনের পোষাকের সমাহার ঘটেছে বিপনী বিতানগুলোতে। প্রতিটি পাঞ্জাবির দাম ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে।

তবে এবারকার ঈদকে সামনে রেখে কষ্ট বাড়ছে নি¤œ আয়ের মানুষদের। এই প্রতিবেদকের কথা হয় কিশোরগঞ্জ থেকে আগত রিক্সা চালক রহমত আলীর সাথে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মৌলভীবাজার পৌর শহরে থেকে রিক্সা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। এবারের ঈদে ছেলে-মেয়েদের জন্য ঈদের জামাকাপড় ক্রয় করেছেন কী না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কী আর কমু বাবা দুঃখের কথা। ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীসহ পরিবারে আমি সহ ৫ জন লোক। গত দুই বছর করোনার সময় সন্তানদের নিয়ে খুবই কষ্টে দিন কেটেছে। রমজান মাসে সারাদিন যা রুজি করি তা দিয়ে কোন রকম চাল-ডাল ক্রয় করে নিয়ে যাই। পরিবারের লোকজন বেশী তাই এখন কেনাকাটা করি নাই।

এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় শহরের জুলিয়া শপিং কমপ্লেক্সের ক্রেতা পারভেজ আহমদের সাথে। তিনি জানান, ঈদ আসতে আরও কয়েকদিন বাকী। পরিবারের দুই ছেলে ও স্ত্রীর জন্য পছন্দের কাপড় ক্রয় করতে এসেছেন তিনি। এখানে পোষাকগুলোও মোটামুটি ভাল ও রুচিসম্মত। দুই ছেলে মাহিন ও মাহদির জন্য দুই হাজার টাকা দিয়ে দুটি পাঞ্জাবি ও স্ত্রীর জন্য ২ হাজার টাকা দিয়ে একটি শাড়ি ক্রয় করেছি। এছাড়া নিজের জন্যও একটি পাঞ্জাবি ক্রয় করেছি।

এমবি ক্লথ ষ্টোরের ক্রেতা তাহসিনা রহমান জানান, গত দুই বছর করোনা থাকায় ঈদে আসলে তেমন কিছু কেনাকাটা করা হয়নি। যেহেতু এই বছর করোনা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাই কিছুটা কেনাকাটা করা যাচ্ছে। কয়েকদিনে আগে এসে ঘুরের পছন্দ করে দেখে গেছি এখন ক্রয় করতে এসেছি।

শহরের জুলিয়া শপিং সিটির নাহার ক্লথ স্টোরের স্বত্তাধিকারী মিনহাজ আহমদ জানান, করোনা নিয়ন্ত্রণে আসায় সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসায় ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি। যদিও গত দুই বছর ঈদের মৌসুমে বাণিজ্য হয়নি। এ সময় সাধারণ ব্যবসাটাই হয়নি। তাছাড়া ব্যাংক লোনও ছিল। সুতরাং বড় লোকসানের কবলে পড়তে হয়েছে আমাকে। এ বছর করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় এবার আগে থেকেই ব্যবসা চাঙ্গা হতে শুরু করেছে।

বিলাস ক্লথ ষ্টোরের প্রোপাইটার সুমন আহমদ বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা যা চিন্তা করেছিলাম তাই হয়েছে। সব বছরের মতো এবার ব্যবসা তেমন ভাল হয়নি। কারণ ক্রেতাদের হাতে এবার বাজেট কম। রমজানের প্রথম থেকেই আমরা কাপড় বিক্রি করে সেটা বুঝেছি। সব মিলিয়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় ব্যবসায়ীদের শতকরা ২০ শতাংশ কম ব্যবসা হয়েছে। সব বয়সী ক্রেতাদের চাহিদা ও পছন্দ বিবেচনা করে দেশি-বিদেশি বিপুল পরিমাণের পোশাক আনা হয়েছে। তবুও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি ব্যবসার গতিকে আরো চাঙ্গা করতে।

মৌলভীবাজার বিজনেস ফোরামের সভাপতি কামরান আহমদ বলেন, সরকার করোনার নিষেধাজ্ঞা তুলায় মৌলভীবাজারের সৌখিন প্রবাসীরা রমজানের আগে ইউরোপ-আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে আসেন। পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে রমজানের আগেই ঈদের কেনাকাটা শেষ করেন।

মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ জাকারিয়া মুঠোফোনে বলেন, ঈদকে সামনে রেখে ক্রেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ কাজ করছে। বিপনী বিতানগুলো ছাড়াও পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব শহর ও শহরের বাইরে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ও পয়েন্টে সার্বক্ষনিক টহল দিচ্ছেন। ঈদ পরবর্তী সময়ে জেলার বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকরা যাতে নির্বিঘেœ ঘোরাফেরা করতে পারেন সেজন্য টুরিস্ট পুলিশ ও থানা পুলিশের নিরাপত্তা বাড়ানো হবে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *