জেলা প্রতিনিধি, সিলেট :
শতবছরের ভয়াবহ বন্যায় চরম বিপর্যস্থ সিলেট। বন্যার তীব্রতায় ভেঙে পড়েছে অবকাঠামো। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থাও। এখন বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। এরই মধ্যে প্লাবিত হয়েছে বিভাগের সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। ফলে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক স্বাস্থ্য পরিষেবাও। তাছাড়া বন্যা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহেও সংকট দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সব মিলিয়ে বন্যা-পরবর্তী এক মাস ওই অঞ্চলের মানুষকে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়তে হতে পারে বলে ধারণা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সিলেট নগরীর অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের নিচতলা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। রোববার পানি কমতে শুরু করলেও এখনো শহরের ৫০ শতাংশ এলাকায় পানি রয়েছে।এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভবনে পানি প্রবেশ করায় বন্ধ রাখা হয়েছে নিচতলার সেবা কার্যক্রম। বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটর দিয়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ), সাধারণ অস্ত্রোপচার, শিশু বিভাগের কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ সদরসহ ১২টি উপজেলার সব হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতাল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। সিলেটের মাত্র তিনটি উপজেলার হাসপাতাল পানিতে নিমজ্জিত হয়নি। টিলার ওপরে থাকায় জৈন্তাপুর, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে। প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হিমাংশু লাল রায় জানান, পুলিশ, প্রশাসন, আর্ম ফোর্স ও ত্রাণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনায় বেগ পেতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, পানি নেমে গেলে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়বে। এজন্য আমরা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন ইত্যাদি সরবরাহ করছি। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, ডক্সিসাইক্লিন ওষুধের সংকট হতে পারে। সাধারণত জুনে ওষুধ কেনা হয়। এখন ওষুধের স্বল্পতা সব জায়গায়ই রয়েছে। আমরা সরবরাহ ঠিক রাখতে চেষ্টা করছি। অনেকে ওষুধ বিনামূল্যে দিচ্ছে।
বন্যা-পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়বে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক অক্সফোর্ড একাডেমি জার্নাল ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্যাডিয়াট্রিক ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নাল বলছে, বন্যার সময়ে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু, সাপের কামড়, বিভিন্ন রাসায়নিক পানিতে মিশে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। বন্যা-পরবর্তী ১০ দিনে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার কারণে নিউমোনিয়া, শ্বসনতন্ত্রের রোগ, ডায়রিয়া, কলেরা, গ্যাস্ট্রিকের মতো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। দুর্গত এলাকার মানুষ মানসিক ব্যাধিতেও আক্রান্ত হতে পারে।
সুনামগঞ্জে বন্যাদুর্গতদের কাছে ওষুধের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য মৌলভীবাজার স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধের সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ।
তিনি বলেন, আমরা জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। যারা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসতে পারছেন না, তাদের জন্য আমরা ওয়ার্ড ও ইউনিয়নভিত্তিক টিম করে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছি। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সুনামগঞ্জে ঘাটতি হওয়ায় আমরা সেখানে ওষুধ, ১৫ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও ২০ হাজার স্যালাইন দিয়েছি। বন্যা-পরবর্তী সময়ে টেট্রাসাইক্লিন, সিপ্রোসিনের সংকট তৈরি হতে পারে।
বন্যার সময়ে তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা বিঘিœত হওয়া স্বাভাবিক হলেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ।
তিনি বলেন, বন্যার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ও হাসপাতালগুলো পানির নিচে থাকায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। আহত হওয়া, হার্ট অ্যাটাক, প্রসূতি সেবার মতো জরুরি সেবা নিতেও কেউ হাসপাতালে আসতে পারছেন না। তাছাড়া বন্যা-পরবর্তী নানা রোগের সংক্রমণ বাড়বে। এ কারণে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সংকট সৃষ্টি হবে। ওষুধের সংকট সরাসরি দেখা না গেলেও সরবরাহে সংকট সৃষ্টি হতে পারে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সময়মতো ওষুধ নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, শহরের যেসব চিকিৎসাকেন্দ্র পানির নিচে ডুবে গিয়েছিল সেখান থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। আমরা জেনারেটর দিয়ে আইসিইউ, সিসিইউ, সার্জারি ও কার্ডিয়াক বিভাগের চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রেখেছি। জরুরি পরিষেবার জন্য সিলেট ও ঢাকায় টিম গঠন করেছি। একই সঙ্গে সব এলাকায় আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিতদের তাৎক্ষণিক সাড়া দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। বন্যা-পরবর্তী সংকট মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।