ফরেন রেমিটেন্স কমে যাচ্ছে

ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ: বিশিষ্ট আইনজীবী সমাজসেবক ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার নিউহ্যাম বারা জাতিগতভাবে আমরা প্রচন্ড আবেগপ্রবণ। ঘটনার মূলে আমরা যাই না, ঘটনার গভীরে গিয়ে ঘটনাগুলোর মূল কারণ তলিয়ে দেখার প্রয়োজনও অনুভব করি না। দুধর্ষ বা হঠাৎ বড় ঘটনার বা লোমহর্ষক ঘটনার আকর্ষিকতায় আমরা শুধু প্রতিক্রিয়া দেখাতে অভ্যস্ত। ফরেন রেমিটেন্স কেন কমে গেছে বা যাচ্ছে তা কি একবার ভাল করে তলিয়ে দেখা হয়েছে এবং কমার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে? মোটেই না। বরং বারবার বলা হচ্ছে রেমিটেন্স কমছে, প্রবাসীদের রেমিটেন্স কমছে। প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশী দেশের বাহিরে অবস্থান করছেন। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠান মূলত তিনটি কারণে— নিজের খরচের জন্য আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তা ও চ্যারিটির (সদকা, দান) জন্য বিনিয়োগের জন্য শুরু করি শেষেরটি দিয়ে— বিনিয়োগ করে কয়জন প্রবাসী লাভবান হয়েছেন? ঝামেলায় পড়েছেন, সব হারিয়েছেন, প্রতারনার শিকার হয়েছেন, মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে জেলে গিয়েছেন— এমন ঘটন অসংখ্য। সরকারী কোন অফিসে (যেমন: ভুমি অফিস, সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস, রাজউক, ইউনিয়ন অফিস, বিদ্যুৎ অফিস, সিটি কর্পোরেশন, গ্যাসের অফিস, থানা প্রভৃতি) গিয়ে কোন সুপারিশ ও টাকা/ঘুষ ছাড়া সাধারণভাবে একটি কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করলে জীবনে আর কোন দিন বাংলাদেশে বিনিয়োগের নাম মুখে নিবে না। এমতাবস্থায় বিনিয়োগের জন্য বিদেশ থেকে প্রবাসীরা খালি রেমিট্যান্স পাঠাতেই থাকবে কোন কারণে? যে আত্মীয়-স্বজনদের প্রবাসীরা বছরের পর বছর সাহায্য ও সহায়তা করে আসছে সেই আত্মীয়-স্বজনরাই প্রবাসীদের জায়গা-জমি দখল করছে এবং প্রবাসীদের সম্পদে ও সম্পত্তিতে শকুনের মতো কুদৃষ্টি ফেলছে। প্রবাসীদের বেকায়াদায় ফেলতে তাদের নিজ প্রতিবেশী ও গ্রামের লোকেরা সবার চেয়ে অগ্রগামী। আইনী কোন সমাধান পাওয়া যায় না। থানা বা কোর্টে গেলে পড়তে হয় বাড়তি ঝামেলায় ও হয়রানিতে। সারা জীবণ আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তা করার পরও করোনার সময় প্রবাসীদের সাথে কি না আচরন করা হলো! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রু বাড়িতে যেভাবে লাল পতাকা লাগানো হত ঠিক তেমনিভাবে প্রবাসীদের বাড়িতে বাড়িতে লাল পতাকা টানিয়ে দেয়া হয়েছিল! নিজের খরচের জন্য আর কত রেমিট্যান্সে প্রবাসীরা পাঠাতেই থাকবে। যেখানে নিজে দেশে গেলে নিরাপদ নয়, তাদের পরিবারকে নিয়ে যাবে কোন কারণে? বিদেশে বড় হওয়া পরিবার দেশে গেলেও তারা যে করুন ও তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে তাতে তারা বরং প্রতিজ্ঞা করে আর দেশে যাবে না। এমতাবস্থায় কেন তারা দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতেই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে? অথচ কত না সম্ভাবনাময় খাত ছিল প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। যে মুরগী ডিম পাড়ে বা যে গাভী দুধ দেয় সেই মুরগী বা গাভীকে কত না যত্ন করে রাখে মানুষ। অথচ দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন খ্যাত এই রেমিটেন্স প্রেরক প্রবাসীদের সাথে কত না নির্মম ও নির্দয় আচরন করা হয় দেশে গেলে, এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে সব জায়গায়। আবেদন করে পাসপোর্ট পাওয়া যায় না ৮/৯ মাসে। পাসপোর্টের জন্য বিদেশে দুতাবাস/হাই কমিশনে আবেদন করলে দেশের বাড়িতে গিয়ে ভেরিফিকেশনের নামে টাকা চাওয়া হয়, ক্ষেত্রভেদে বড় অংকের ঘুষ চাওয়া হয়। পাওয়ার অব এটর্নী দেয়া প্রবাসীদের জন্য কঠিন করা হয়েছে। নিজ দেশের বিমান হবার পরও প্রবাসীদের কাছ থেকে নেয়া হয় প্রায় দ্বিগুন ভাড়া! NID কার্ড এখনও ইসু করা হচ্ছে না বিদেশের দুতাবাস বা হাই কমিশন থেকে, অথচ দেশে সেটা অনেকটা কমপালসারী (আবশ্যিক) করা হয়েছে যার ফলে প্রবাসীরা দেশে গিয়ে পড়েন বিপদে। দেশে গিয়েও তারা বানাতে পারেন না, পড়েন ঝামেলায় – এটা সেটা বলে অনেকটা প্রকাশ্যেই টাকা/ঘুষ চাওয়া হয়। খোদ এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকার মেইন সিটিতে বা সিলেটের এয়ারপোর্ট থেকে শহরে যাবার জন্য একটি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা ট্রেন পর্যন্ত নাই। আর মুখে শুধু বড়াই ও ফুটানি! এসবগুলো এভাবেই রেখে শুধুই একতরফাভাবে আশা ও প্রত্যাশা করবেন রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য! অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিলাম। বৃটেনে থাকেন অর্ধ মিলিয়নের বেশী বাংলাদেশী। যদি বিনিয়োগের সুন্দর পরিবেশ ও নিশ্চয়তা থাকতো, দেশ ভ্রমনে প্রবাসীদের নিরাপত্তা থাকতো, প্রবাসীদেরকে আলাদাভাবে সম্মানের চোখে দেখা হতো এবং তাদের কাজ ফাস্টট্রাকে করে দেয়ার ব্যবস্থা করা হতো, বিশ্বাস করুন শুধু বিলেত থেকে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড দেশে রেমিট্যান্স আকারে দেশে যেত। এখন যা হবার তাই হবে বা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে রেমিট্যান্স প্রেরণের মাত্রা আস্তে আস্তে কমতে কমতে একেবারে তলানীতে গিয়ে ঠেকবে। আগ্রহভরে বা বিনিয়োগের জন্য নয় বরং নিতান্ত বাধ্য হয়ে প্রবাসীরা যতটুকু না পাঠালে না হয় (যেমন আত্বীয়দের সাহায্য, লিল্লাহ) সেই পরিমান রেমিটেন্স পাঠাবেন। তাই দেরী হবার আগে এই বিষয়টি দেখুন যাদের দেখার কথা, ভাবুন যাদের ভাবার কথা। রেমিট্যান্স কমার মূল কারণ তলিয়ে দেখুন। মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করুন। নতুবা প্রকারান্তরে দেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কঠিন সমস্যায় পড়বেন আপনারাও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *