বাবা ফেরার অপেক্ষায় ২৭ বছর!

মাহফুজ শাকিল : পৃথিবীর ছোট ও মধুর শব্দগুলোর মধ্যে বাবা ডাকটি অন্যতম। এ শব্দটির সঙ্গেই যেন জড়িয়ে আছে ভালোবাসা, নির্ভরতা আর ভরসার ছায়া। কিন্তু সেই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন তিন ভাই। ২৭ বছর আগে তাদের বাবা ঢাকায় গিয়ে আজও ফিরেননি। তাঁর ফেরার অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তিন ভাই রুবেল, সৌরভ ও পায়েল। তারা এখনো জানেন না তাদের বাবা বেঁচে আছেন নাকি আদৌ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। আর তাদের মাতা রহিমা আক্তার শেফালি অশ্রুসিক্ত নয়নে আজও স্বামী ফেরার পথে চেয়ে থাকেন। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনাটি হলো মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার।

কুলাউড়ার অতি পরিচিত মুখ সদা হাস্যোজ্জ্বল আব্দুল হান্নান নিজ গাড়ী ও ড্রাইভার গিয়াসকে যাত্রীবেশী কতিপয় যুবক অপহরণ হওয়ার ঘটনার ২৭ বছর ৬ মাস অতিবাহিত হলেও আব্দুল হান্নান ও তাঁর সহযোগী আজও ঘরে ফেরেননি। আব্দুল হান্নান কুলাউড়া পৌর শহরের উছলাপাড়া নিবাসী মরহুম আব্দুস ছত্তারের প্রথম পুত্র। নিখোঁজ হান্নানের দ্বিতীয় পুত্র শফিউল আলম সৌরভের মনে আজও প্রশ্ন জাগে, বাবা ফিরবে তো? বাবাকে স্বচক্ষে দেখতে পারব তো? সদা হাস্যোজ্জ্বল বাবা দীর্ঘ ২৭ বছর ৬ মাস ধরে নিখোঁজ।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫ সাল। কুলাউড়ার ডাকবাংলো মাঠে বিজয় মেলা-৯৫-এর সমাপনী অনুষ্ঠান চলছিল। কুলাউড়াবাসীর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ঢাকা থেকে আসা সাতজন যুবক মেলায় অনেকক্ষণ ঘুরাফেরা করে মেলা থেকে বেরিয়েই প্রায় ৩০০ গজ উত্তরে গিয়ে রাস্তায় একটি লাইটেস দাঁড়ানো দেখে ড্রাইভারকে তারা জানান, তারা ঢাকার বাসিন্দা। মাধবকুন্ড জলপ্রপাত দেখতে এসেছিলেন। তারা ঢাকায় ফেরত যেতে চান। লাইটেস মডেলের মাইক্রোবাসের ড্রাইভার তাদের কাছ থেকে ৩৫০০ টাকা ভাড়া চান। ড্রাইভার গিয়াস যখন যুবকের সঙ্গে আলাপ করছিলেন, তখন গাড়ির মালিক আব্দুল হান্নান সেখানে উপস্থিত হন। আব্দুল হান্নান অবশেষে ঢাকার মালিবাগে যুবকদের নিয়ে যেতে রাজি হন। ১২০০ টাকা অগ্রিম এবং বাকি টাকা ঢাকা যাওয়ার পর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তখন সন্ধ্যা ৭টা বাজে। লাইটেস গাড়িটির নম্বর ঢাকা মেট্রো-চ-০২-৪৫৭৭। ড্রাইভার গিয়াস যাত্রীবেশী কথিত যুবক ও গাড়ির মালিক আব্দুল হান্নানকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। সেই থেকে আজ অবধি গাড়ির মালিক আব্দুল হান্নান ও চালক গিয়াস নিখোঁজ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫ থেকে এখন ২০২৩ সাল। কেটে গেল ২৭টি বছর ৬ মাস। কিন্তু পরিবার-পরিজন এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন, তারা ফিরবেন। কিন্তু কোনো কূলকিনারা হয়নি। নিখোঁজ হান্নানসহ তার সহযোগী আজও ঘরে ফেরেননি।

হান্নান নিখোঁজের ৭ মাস পর স্ত্রী শেফালীর গর্ভে জন্ম নেয় ছোট পুত্র পায়েল। ওই কালো রাত অবধি বড় ছেলে রুবেল (৬), আর দ্বিতীয় ছেলে সৌরভ ছিল ৪ বছরের শিশু। ৩ পুত্রের মধ্যে বড় ছেলে মাহবুব আলম রুবেল বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কাজ করছে। দ্বিতীয় ছেলে শফিউল আলম সৌরভ মাস্টার্স শেষ করে ট্র্যাভেলস ব্যবসা করছে আর ছোট ছেলে শাহরিয়ার আলম পায়েল কোরআনের হিফজ শেষ করে বর্তমানে স্পেনে বসবাস করছে।

নিখোঁজ আব্দুল হান্নানের ছোট ভাই স্পেন প্রবাসী সাংবাদিক তুতিউর রহমান জানান, আব্দুল হান্নান ও চালক গিয়াসকে গাড়িসহ অপহরণ করা হয়েছে বলে ঘটনার দুদিন পর অনুমান করা হয়। তারা ফিরে না আসায় তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কুলাউড়া থানায় জিডি ১৯৯৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর (নং-৬৫১) করা হয়। পরে এজাহার দায়ের করা হয়। পরবর্তী সময়ে মামলা ডিবি মৌলভীবাজারে স্থানান্তরিত হয়। ১৫ এপ্রিল ১৯৯৬ সালে ডিবি থেকে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু অদ্যাবধি নিখোঁজ দুই ব্যক্তিসহ ছিনতাইকৃত গাড়িটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

“যে রাত চির অন্ধকার নিয়ে এসেছিল, নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে” বলে আব্দুল হান্নানের ছেলে শফিউল আলম সৌরভ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ওয়ানওয়ে জীবন জার্নির অনন্ত পথেই বুঝি চলে গেলেন আমাদের বাবা। বাবা একদিন হঠাৎ ফিরে আসবেন এমনি স্বপ্নে বিভোর ছিলাম আমরা। একে একে প্রায় তিন দশক অতিবাহিত হলেও বাবা আর আমাদের মাঝে ফিরে আসেননি। বাবার কোল থেকে কাঁধে ওঠা, আদরে চুম্বনে এদিক ওদিক ছোটে চলা, এটা ওটার বায়না এমনি স্মৃতিতে সযতনে রক্ষিত রেখেছি আমার বাবাকে। বাবা হারানোর ব্যথা বা বাবাহীন জীবনের কষ্ট কত যে ভয়ানক, যে বাবা হারায়নি সে এ ব্যথা বুঝবে না। বাবাহীন প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে আমাদের। বাবার শাসন-¯েœহ-ভালোবাসা ছাড়াই জীবনের অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেল। সবাই বাবা দিবসে বাবাকে উইশ করতে পারে কিন্তু আমাদের সেটা হয়না।

সৌরভ আরো বলেন, আকাশ দেখে দেখে চোখ ভেজে জ¦লে- বাবা তুমি কেমন করে আমাদের ছেড়ে গেলে? বড় হয়ে যখনই এ কুলাউড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ কারো সাথে প্রসঙ্গক্রমে তোমার সন্তানের পরিচয় দিয়েছি, তখনই স্বীকৃতি পেয়েছি, নিরেট ভাল মানুষ ছিলেন বাবা। মাথায় তোমার হাত না বুলালেও তোমার সাজানো ছকেই পারিবারিক কাঠামোতে আমরা সুগঠিত হচ্ছি। আমরা বড় হয়েছি বাবা, তুমি আর আমাদের আতিশয্যে ফিরবে না হয়তো- এটাও বোধ হয় নিশ্চিত। ওই যাত্রীবেশী পাপিষ্ট হায়েনারা তোমাকে মেরে ফেললেও তোমার শবাধার পাবার ভাগ্যটাও আমাদের হল না। ইহজগতে আমরা কেউই থাকব না জানি কিন্তু তোমার সমাধির সন্ধান পেলে আমরা সমাধিতে হাত বুলিয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে কেঁদে পরম করুণাময় মহান আল্লাহ পাকের কাছে শুধু আমাদের পিতৃহীন যন্ত্রনার ফরিয়াদ করতাম। পৃথিবীর ৫০০ কোটি মানুষের মাঝে তুমি কি বেঁচো আছো বাবা? যদি পারলৌকিক বাসিন্দা হয়েই থাকো, তবে তোমার সৎ জীবন আর শে^ত শুভ্র, ছিমছাম সাদা চলাফেরার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাপাক যেন তোমাকে জান্নাতে আসীন করেন- অনন্ত অম্বর হতে প্রার্থনা করছি।

দেশে এখন ঘুম-খুন, অপহরণ অহরহ ঘটলেও তৎকালীন সময়ে ড্রাইভার, গাড়ীসহ আব্দুল হান্নানের নিখোঁজের বিষয়টি কুলাউড়াসহ সিলেট বিভাগ জুড়ে ব্যাপক আলোচিত ছিলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *