সহস্ত্রাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত শেখানো সুদর্শনের ঘরে এখনো বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি

মাহফুজ শাকিল : দেশের প্রায় সহস্রারাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুদ্ধসুরে জাতীয় সঙ্গীত শেখানো সুদর্শন রবিদাস (৬৩) এখন আর বেশ ভালো নেই। অভাব-অনটনের সংসারে অনেকটা অনাহারে-অর্ধাহারে তিনি দিনাতিপাত করছেন। কেউ এখন আর তাঁর খোঁজ রাখেননা। দেশমাতৃকার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে অবিরাম ছুটে চলা জাতীয় সংগীতের ফেরিওয়ালা খ্যাত মহান ব্যক্তি সুদর্শন রবিদাস মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের রাঙ্গিছড়া চা-বাগানের বাসিন্দা। সুদর্শনের আর্থিক অবস্থা অস্বচ্ছল থাকায় পরিবারের স্থায়ী কোন উৎস নেই। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার মোতাবেক দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আসলেও সুদর্শনের ঘরে এখনো বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি। ফলে পরিবারের সন্তানদের নিয়ে তিনি অন্ধকারের মধ্যে জীবনযাপন করছেন। আর্থিক সমস্যার কারণে বিদ্যুৎ মিটার ক্রয় করতে পারছেন না। সরকারিভাবে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য গত ২৩ আগস্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে একটি লিখিত আবেদন করেছেন সুদর্শন।

সুদর্শন রবিদাস আক্ষেপ করে জানালেন, তিন বছর থেকে বসতবাড়িতে বিদ্যুতের সমস্যায় ভূগছেন। ১৭ থেকে ২০ হাজার টাকা হলে বিদ্যুতের মিটার, লাইনসহ সংযোগ খরচ লাগবে। কিন্তু আমার পক্ষে টাকা যোগাড় করা সম্ভব হয় নয় তাই বলে কি আমি বিদ্যুৎ সেবা থেকে বঞ্চিত হবো। আমার ঘর থেকে প্রায় ২৫-৩০ ফুট দূরে সরকারি বিদ্যুতের লাইন আছে কিন্তু মিটার ব্যবস্থা করতে না পারায় বিদ্যুৎ সংযোগ করতে পারছি না। এজন্য সরকারিভাবে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ইউএনও স্যারের কাছে আবেদন করেছি।

সম্প্রতি সুদর্শন রবিদাসের বাড়িতে সরেজমিন গেলে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় তাঁর। এসময় তিনি তাঁর ঘরে বিভিন্ন সময় পাওয়া সম্মাননা সনদসহ পুরস্কারগুলো দেখালেন। আবেগআপ্লুত হয়ে বলেন, অনেক সম্মাননা পেয়েছি, কিন্ত আমার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি।

এক সাধারণ দরিদ্র চা শ্রমিক পরিবারে বেড়ে ওঠা সুদর্শন রবিদাস অসম্ভব তেজস্বী একজন চারণ সঙ্গীত শিল্পী। পাশাপাশি ছড়া, কবিতা, গল্প, দেশাত্মবোধক গান, কৌতুক, শরীরচর্চা আর অন্যান্য গানের পাশাপাশি যিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুদ্ধ সুরে জাতীয় সঙ্গীতের তালিম দিয়ে যাচ্ছেন বিরামহীন ভাবে। সময়মতো অ্যাসেম্বলি শুরু হতেই ভোরের পাখিদের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সারাদিন স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষার্থীদের মাঝখানে গিয়ে তিনি সঠিক স্বরলিপি, সুর ও কথায় গেয়ে চলছেন “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”।

দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে ২০১৩ সাল থেকে তিনি দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজ উদ্যোগে অর্থ ব্যয়ে দেশের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো বা বাস চড়ে বিগত দশ বছর ধরে শুদ্ধ জাতীয় সংগীত শিখানোর মিশনে কাজ করছেন। এ পর্যন্ত কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ী, রাজনগর, কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলা, সিলেট বিভাগের বিভিন্ন উপজেলাসহ দেশের প্রায় সহ¯্রাধিক শতাধিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধ সুরে জাতীয় সংগীত শিখিয়েছেন।

সুদর্শন রবিদাস কুলাউড়া উপজেলার লংলা চা বাগানের কুকি টিলা বড় লাইনের বাসিন্দা মৃত দেওনারায়ণ রবিদাসের পুত্র। তাঁর জন্মের ৬ মাসের মাথায় তাঁর মা মারা গেলে নানা বলরাম রবিদাস একই উপজেলার রাঙ্গীছড়া চা বাগানের বড় লাইনে নানী দুখনতিয়া রবিদাসের কাছে নিয়ে আসেন। এখানেই তিনি লালিত-পালিত হন। তাঁর ৪ ছেলে সন্তান রয়েছে। ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর স্ত্রী সুগিয়া রবিদাস দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে স্ট্রোক করে মারা যান। বর্তমানে ছোট ছেলে লক্ষী নারায়ন ও গণেশের সাথে রয়েছেন তিনি।

কুলাউড়া বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী রাসেল আহমাদ বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যদি ওই ব্যক্তি আমার কার্যালয়ে আসেন তাহলে উনাকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিষয়ে সহযোগিতা করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহমুদুর রহমান খোন্দকার বলেন, সুদর্শন রবিদাস নিজের আবেগ ও ভালোবাসার জায়গা থেকে দেশপ্রেমে উদ্ধুব্ধ হয়ে এই মহৎ কাজটি করে যাচ্ছেন। তাঁর জন্য আমরা সবাই অনেক অনুপ্রাণিত ও মুগ্ধ। বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে আলোচনা করে সুদর্শনের ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *