থানা পুলিশহীন, হামলা-লুটপাটে ‘আতঙ্ক’

অনলাইন ডেস্ক: রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ থানায় এখন পুলিশের কোনও সদস্য নেই। সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করছেন। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য আত্মীয়স্বজনের বাসায় অবস্থান করছেন অনেকে। সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আত্মগোপন করেছেন।

এরকম পরিস্থিতি কোনোদিন দেখা যায়নি–

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সারা দেশে চার শতাধিক থানায় হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ- লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এই অবস্থায় থানায় বা নিজ নিজ কার্যালয়ে থাকা কেউ নিরাপদ মনে করছেন না। ফলে যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়েছেন। এছাড়া অনেক জায়গায় সেনাবাহিনীর সহায়তায় জনরোষে আটকে পরা পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নেওয়া হয়েছে।

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সোমবার (৫ আগস্ট) বিকাল থেকে জনরোষের মুখে পড়ে অন্তত অর্ধশত পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় নিহতদের প্রকৃত পরিসংখ্যানও জানা যায়নি।

বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, ভাটারা, মোহাম্মদপুর, আদাবর, মিরপুর, পল্টন, শাহআলী, উত্তরা পূর্ব থানাসহ বিভিন্ন থানায় সোমবার বিকাল থেকে রাতভর হামলা এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অবশ্য রাতে বিভিন্ন থানা থেকে সরে যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অনেক থানা পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। থানার ভেতর থেকে ফ্যান, চেয়ার-টেবিলসহ সব ধরনের জিনিসপুত্র লুট হয়ে গেছে। অনেক থানা থেকে অস্ত্র ও গোলা বারুদও লুট করা হয়েছে।
ঢাকার বাইরের এক পুলিশ সুপার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, থানাগুলোতে যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তাতে আগের অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লাগবে। এছাড়া পুলিশ সদস্যরা নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছেন, তারা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেবেন কীভাবে? এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে তাও অনুমান করতে পারছেন না কেউ।

পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, একাত্তরের পরে এইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি পুলিশ। সোমবার রাতে পুলিশ সদর দফতরে হামলা হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হেলিকপ্টারে উদ্ধার করে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। অনেকেই প্রাচীর ডিঙিয়ে নিরাপদে সদর দফতর থেকে বের হয়ে যান। রাতে রাজারবাগেও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।

পুলিশের দায়িত্বশীল আরেক কর্মকর্তা জানান, গুটিকয়েক কর্মকর্তার রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তির জন্য পুলিশের এই করুন অবস্থা তৈরি হয়েছে। সেসব কর্মকর্তা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য অধস্থনদের জোর করে সাধারণ ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি জুলুম ও অত্যাচার করাতেন। কেউ হুকুম না মানলে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তসহ কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বদলি করে দিতেন।

ওই কর্মকর্তা জানান,আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে  ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশনাই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি করা সিনিয়র কর্মকর্তারাই সাধারণ পুলিশ সদস্যদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

রাজনীতিকরণ নিয়ে ক্ষোভ

পুলিশকে স্বাধীনভাবে আইনের প্রয়োগ করতে না দিয়ে রাজনীতিকরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, যখন যে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে তখন সেই সরকার পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই রাজনীতিকরণ আগের চেয়ে বেশি হয়েছে।

পুলিশের নাম পর্কাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের এই রাজনীতিকরনের মূলহোতা ছিলেন বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা প্রলয় কুমার জোয়ারদার। ২৪ ব্যাচের এই কর্মকর্তা ২০০৯ সালে সদ্য পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সালে তিনি পুলিশ সদর দফতরে এডিশনাল এসপি হয়েও পুলিস সুপার হিসেবে এআইজি আরএন্ডএম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার থাকার কারণে পুলিশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। তার কথা ছাড়া পুলিশের কারও পদোন্নতি বা পদায়ন হতো না। তিনি বেছে বেছে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও পদায়নের ব্যবস্থা করতেন।

IMG-20240806-WA0003হামলা ও লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে অনেক থানায়, মোহাম্মদপুর থানার চিত্র (ছবি: কবির হোসেন)

পুলিশের ২৪ ব্যাচের এক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, তাকে আট বার সুপারসিট (পদোন্নতি বঞ্চিত) করা হয়েছে। প্রত্যেকবার পদোন্নতির তালিকা থেকে নাম কেটে দিয়েছেন প্রলয় কুমার জোয়ারদার। অথচ ২০১৬ সালে ১৩৪ নম্বর তালিকায় থেকেও নিজে ২৫ জনের তালিকায় নাম ঢুকিয়ে পদোন্নতি নিয়েছেন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রলয় এমন ক্ষমতাবান হয়েছিলেন যে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও তার রুমে গিয়ে বসে থাকতেন।

পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১৫ জন কর্মকর্তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে থেকেও সরাসরি রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। ভালো পোস্টিং পাওয়ার জন্য অনেকেই তাদের সমীহ করতেন এবং তাল মিলিয়ে চলতেন। এই ১০-১৫ জন কর্মকর্তার জন্য সবাইকে এখন মাশুল গুনতে হচ্ছে।

ডিবি হারুনকে আটকের গুজব

এদিকে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর পেয়ে ‘ডিবি হারুন’ নামে খ্যাত ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বিমানবন্দর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এসময় একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি।

সূত্র জানায়, সোমবার দুপুরের পর হারুন পুলিশ সদর দফতর থেকে বের হয়ে যান। তবে মঙ্গলবার দুপুরেও তাকে হোয়াটসঅ্যাপে একটিভ দেখা যায়। অপর একটি সূত্র জানায়, হারুন বর্তমানে নিরাপদ স্থানে আত্মগোপনে আছেন। তার পরিবারের সদস্যরা কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছেন। তিনিও যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *