নিজস্ব প্রতিনিধি:
১৯৭৫ সাল থেকে জার্মানভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলে বাংলা বিভাগ চালু হবার পর, এই প্রথম বাংলা বিভাগের প্রধান হিসাবে খালেদ মহিউদ্দিনের চুক্তি নবায়ন না করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে বাংলা বিভাগের তিনজন প্রাক্তন প্রধানের মধ্যে দুইজন দীর্ঘ সময় চাকুরী করে অবসরে যান এবং অন্যজন এশীয়া বিভাগের প্রধান হন।
প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যেই তাদের ওয়েব সাইটে বাংলা বিভাগের প্রধান পদে আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে একজন নতুন লোক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।
উল্লেখ্য ২০১৯ সালের মে মাসে ডয়েচে ভেলে বাংলা বিভাগে যোগ দিলেও ২০২০ সাল থেকে ‘খালেদ মহিউদ্দিন জানতে চায়’- শিরোনামে একটি টক-শো উপস্থাপনা করতেন। এই বিষয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। ২০২০ সালের ২৮ ফেবু্রয়ারী থেকে একটি টকশো শুরু করবার বিষয়ে ঘোষনা দেন।
সেই সম্মেলনে উপস্হিত ছিলেন ডয়চে ভেলের এশিয়ার প্রধান দেবারতি গুহ, জার্মান দূতাবাসের পলিটিক্যাল এ্যটাশে ইনসে দরশাখ বের্গ এবং খালেদ মহিউদ্দিন উপস্হিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করবেন প্রতিষ্ঠানটির বাংলা টিমের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দীন। আর টকশোটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘খালেদ মুহিউদ্দিন জানতে চায়’। সেই সম্মেলনে ডয়চে ভেলের এশিয়ার প্রধান দেবারতি গুহ জানিয়েছিলেন, „টকশোতে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন সমস্যার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হবে। বিশেষ করে বর্তমান এই সময়ে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্রপন্থী চাড়া দিয়ে উঠছে, বাকস্বাধীনতা হস্তক্ষেপ করছে যত্রতত্র। এই সময়ে ডয়চে ভেলের ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে আমরা আপনাদের আরো কাছে আসতে চাই।’
প্রচন্ড জনপ্রিয় এই টক-শো উপস্থাপনা করলেও তাকে কেন ডয়েচে ভেলে সরিয়ে দিল তা নিয়ে দেশে বিদেশে নানা রকম কথাবার্তা হচ্ছে।
বিভিন্ন বিশ্বস্ত সুত্র ও জার্মানির প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের শুভলগ্নে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর শুভেচ্ছা বার্তা দিয়ে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠান শরু হয়। বিগত সময় ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের স্বনামধন্য ব্যাক্তিবর্গ কাজ করেছেন।
দুর্ভাগজনক ভাবে খালেদ মহিউদ্দিন প্রথম থেকেই জার্মানভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলে বাংলা বিভাগকে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচার প্রচরনার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। অল্পদিনেই ‘খালেদ মুহিউদ্দিন জানতে চায়’ টকশোটি বিপুল জনপ্রিয়তা পেলেও অনেকের মাঝে ক্ষোভ দেখা দেয়।
অতিথিদের তার টকশোতে ডেকে নিয়ে এসে বিভিন্ন বিব্রতকর প্রশ্ন করাকে অনেকেই অপসাংবাদিকতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে তিনি অনেককে আমন্ত্রণ জানিয়ে আক্রমাত্মক প্রশ্নমালা ছুড়ে দিতেন। অনেক রাজনীতিক ব্যাক্তিবর্গকে নিয়ে কটু কথা বলতেন। যা ডয়চে ভেলের নীতিমালা বিরোধী।
একজন সঞ্চালক হিসাবে খালেদ মহিউদ্দিনের নিরপেক্ষ থাকবার কথা রইলেও, তিনি তা করতেন না। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এবং আওয়ামী লীগকে হেয় প্রতিপন্ন করার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই তিনি এই অনুষ্ঠানটি করতেন বলে জানিয়েছে একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সূত্র বলছে, খালেদ মহিউদ্দিনের এবং তার সহযোগী আরাফাতুল ইসলাম ডয়েচে ভেলে বাংলা বিভাগ ক্রমাগত অনেক নেতিবাচক প্রতিবেদন তৈরি করছে। তারা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য জার্মানির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ডেনমার্কের মালমো শহরে তাসনিম খলিলের ব্যাক্তি পরিচালিত নেত্র নিউজের সাথে একটি সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করেছে।
জার্মান প্রবাসী বাংলাদেশীরা জানিয়েছে, ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠান শরুর পর থেকে সব সময় বাংলাদেশকে নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও নিরেপক্ষ সংবাদ সহ জার্মানিতে বসবাসরত প্রবাসীদের নিয়ে নানা অনুষ্ঠান প্রচারিত হত। কিন্তু খালেদ মহিউদ্দিন, ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগ প্রধানের দায়িত্ব নেবার পর থেকে তিনি ও তার একজন সহকর্মী বাংলা বিভাগকে তাদের রাজনীতি এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
প্রবাসীদের সুত্রগুলি জানিয়েছে, ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের এহেন বাংলাদেশ বিরোধী উস্কানিমূলক অনুষ্ঠানের জন্য গত বছর বার্লিন ও বন শহরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পক্ষ থেকে গত বছর এপ্রিল মাসে ডয়েচে ভেলের দপ্তরের সামনে দুটি মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হয়। তারা জার্মানির জনগনের করের অর্থায়নে পরিচালিত এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কিছু ব্যাক্তি, তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ ও দর্শন ডয়চে ভেলের মাধ্যমে প্রচার করছে বলে জানিয়েছিল।
তারা ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগ ক্রমাগত ভাবে অনেকগুলি নেতিবাচক প্রতিবেদন তৈরি এবং বাংলাদেশ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবার অপপ্রয়াস বলে মনে করে উর্ধতন কতৃপক্ষকে স্বারকলিপি প্রদান করেছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের একজন কর্মী জানিয়েছে, ডয়চে ভেলের ওপরের মহল থেকে বারবার সতর্কতা ও ডয়চে ভেলের নীতিমালা সমন্ধে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধানকে ওয়াকাবহাল করলেও, তিনি তা আমলে না নিয়ে তিনি তার টকশোর অভাবনীয় সাফল্যের কথা বলতেন। কিন্তু জার্মান সংবাদ মাধ্যমের নীতিমালা না মানার কারণে ইতিপূর্বে এই প্রতিষ্ঠান থেকে আরো কিছু সাংবাদিকদের চাকুরী যাবার কথা খালেদ মহিউদ্দিন জানতেন না।
নীতিমালা বিষয়ে ডয়চে ভেলে আইন (DWG) (ফেডারেল অফিস অফ জাস্টিস, ১৯৯৭) অনুসারে:
ক) §৫(২) আইন বলছে: “অনুষ্ঠানগুলি অবশ্যই জনসাধারণকে স্বাধীন মতামত তৈরি করতে সক্ষম করতে হবে এবং একতরফাভাবে একটি দল বা অন্যান্য রাজনৈতিক সমিতি, একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়, একটি পেশা বা স্বার্থের সম্প্রদায়কে সমর্থন করবে না “
খ) §৫(৩)আইন বলছে: “প্রতিবেদনগুল সত্য এবং বাস্তবসম্মত হতে হবে এবং ডয়েচে ভেলের অনুষ্ঠানগুলি গুলি অন্যান্য দেশের সাথে ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানির সম্পর্ককে প্রভাবিত করে সে বিষয়ে সচেতনতার সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে।”
এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশীরা ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে অনৈতিক উপকৌঠন নেবার অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি মানহাইম শহরে একটি বাংলাদেশী কম্পিউটার প্রতিষ্ঠানের মালিক কে নিয়ে ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগে অনুষ্ঠান করার পর এই বছর ৩০ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির ৩০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের রাফ্যেল ড্র তে কৌশলে খালেদ মহিউদ্দিনকে জার্মান বাংলাদেশ- জার্মান বিমান টিকিট হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে উপস্হিত অতিথিরা বিষয়টি দেখে বেশ অবাক হয়ে যান। এছাড়াও আরো কিছু বাংলাদেশীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করার বিনিময়ে তিনি উপহার সামগ্রী গ্রহন করেছেন। যা, জার্মানির সেবা বিষয়ক বিধানে অনৈতিক কাজ হিসাবে বিবেচিত।