বিসিবিতে যেভাবে ‘অজেয়’ হয়ে ওঠেন সভাপতি নাজমুল

তারেক মাহমুদ: ক্রিকেটের প্রাণ থাকলে নিশ্চিত বাংলাদেশে এত বছরে সে হাঁপিয়ে উঠত। অনুনয়–বিনয় করে বলত, ‘আপনাদের তীব্র ভালোবাসার উত্তাপে আমি জ্বলেপুড়ে ছাই হচ্ছি। দয়া করে আমাকে মুক্তি দিন।’

ক্রিকেটকে ‘ভালোবাসা’র জালে আটকে রেখেছিলেন স্বয়ং ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালকেরা, যাঁরা দেশের ক্রিকেটটাকে এতগুলো বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর হঠাৎই তাঁদের বেশির ভাগ দৃশ্যপট থেকে উধাও। এমনকি মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পরও ‘ভালোবাসা’র টানে ক্রিকেট বোর্ড ছাড়তে না পারা বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান নিজেও দেশান্তরি হয়েছেন বলে খবর। ‘ভালোবাসা’র প্রতি যেন কারও একরত্তি দায়বদ্ধতা নেই!

সরকার মনোনীত সভাপতি হিসেবে নাজমুল হাসান প্রথম বিসিবির দায়িত্ব নেন ২০১২ সালে। আইসিসির বাধ্যবাধকতার কারণে ২০১৩ সালের অক্টোবরে সভাপতি হন বিসিবির পরিচালকদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে। এরপর আরও দুটি নির্বাচনেও নির্বাচিত হয়ে এখনো নাজমুলই বিসিবি সভাপতি।

২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর ঘরোয়া ক্রিকেটে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং নিয়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদন
২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর ঘরোয়া ক্রিকেটে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং নিয়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদনপ্রথম আলো

অবশ্য বিসিবির নির্বাচনের প্লটটাই এমনভাবে সাজানো থাকে যে নির্বাচিত হয়ে আসা পরিচালকদের বেশির ভাগই হন সমমনা। তাঁদের ভোটে সভাপতি নির্বাচনটাও অনেকটা নিয়ম রক্ষার। তা ছাড়া প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পুত্র নাজমুল হাসান পারিবারিকভাবেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ। বিসিবির পরিচালনা পরিষদে সভাপতি হতে সাহস করে তাঁর বিপক্ষে দাঁড়ানোর চিন্তাও কেউ কখনো করেননি। আর একচ্ছত্র আধিপত্য পেলে যা হয়, নাজমুল তাঁর অযাচিত ‘ভালোবাসা’র জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছেন দেশের ক্রিকেটকে।

একটা দেশের ক্রিকেটের শিকড় হলো ঘরোয়া ক্রিকেট, বাংলাদেশে যেটাকে একরকম ধ্বংসই করে দিয়েছে প্রায় ১২ বছর ধরে বিসিবির সভাপতি থাকা নাজমুল ও তাঁর পারিষদ।

২০১৪ সালে তৃতীয় বিভাগ বাছাই ক্রিকেটের এন্ট্রি ফি ১ লাখ টাকা থেকে একলাফে ৫ লাখ টাকা করে ঢাকা লিগের গোড়াটাই পচিয়ে ফেলা হয়। প্রতি মৌসুমে তৃতীয় বিভাগ বাছাই ক্রিকেট খেলত একাডেমি পর্যায়ের ৫০-৬০টি দল। হাজার–বারো শ উঠতি ক্রিকেটার সুযোগ পেত প্রতিভার প্রথম স্ফুলিঙ্গ দেখানোর। তাতে ক্লাব ক্রিকেট সমৃদ্ধ হতো, দেশের ক্রিকেটার সরবরাহ সারি স্বাস্থ্যবান থাকত। এক স্কুল ক্রিকেট ছাড়া এত নবীন ক্রিকেটারের একসঙ্গে প্রতিদ্বিন্দ্বতা করার আর কোনো প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে আগেও ছিল না, এখন তো নেই-ই।

স্তরভিত্তিক বাছাই ক্রিকেটে বাড়ানো হয়েছে এন্ট্রি ফি। তাতে ক্ষতি হয়েছে ঘরোয়া ক্রিকেটের
স্তরভিত্তিক বাছাই ক্রিকেটে বাড়ানো হয়েছে এন্ট্রি ফি। তাতে ক্ষতি হয়েছে ঘরোয়া ক্রিকেটেরপ্রথম আলো ফাইল ছবি

একটা টুর্নামেন্টে বেশি ক্রিকেটারের অংশগ্রহণ মানেই বেশি বেশি প্রতিভা উঠে আসার সম্ভাবনা। কিন্তু এন্ট্রি ফি পাঁচ লাখ টাকা করার পর দেখা গেল, কোনো একাডেমি দলই আর তৃতীয় বিভাগ বাছাইয়ে অংশ নিচ্ছে না। পাড়া-মহল্লাভিত্তিক এসব দলের অনেকের সারা বছরের বাজেটই যে পাঁচ লাখ টাকা ছিল না!

এই দলগুলোর ছেঁটে ফেলা আরও নিশ্চিত করতে এরপর নিয়ম আরও কড়া হলো। শর্ত দেওয়া হলো সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের নিবন্ধন ছাড়া কোনো একাডেমি বা ক্লাব তৃতীয় বিভাগ বাছাইয়ে অংশ নিতে পারবে না।

এভাবে অন্যান্য একাডেমি দলের সরে যাওয়ার সুযোগে ১০ বছর ধরে বোর্ড–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুটি করে ক্লাব না খেলেই তৃতীয় বিভাগে উঠেছে। তৃতীয় বিভাগ বাছাইয়ের চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপ নির্ধারিত হয়েছে টসের মাধ্যমে, কখনোবা একটি আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার ‘ফাইনাল’ খেলে। একাডেমিগুলোর প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক উঠতি ক্রিকেটারই ক্রিকেটার হয়ে ওঠার সামর্থ্য দেখানোর সুযোগ না পেয়ে অকালে হারিয়ে গেছে।

বিসিবিতে ভোটের রাজনীতি ভালোই চলে
বিসিবিতে ভোটের রাজনীতি ভালোই চলে

প্রতিবছর নিজেদের দুটি করে ক্লাবকে তৃতীয় বিভাগে তুলতে এই নীলনকশার উদ্দেশ্য ভোটের রাজনীতিতে এগিয়ে থাকা। ‘ভালোবাসার’ ক্রিকেটে জাঁকিয়ে বসতে হলে ভোটে জিততে হবে। আর ভোটে জিততে পকেটে থাকতে হবে ভোটার। গঠনতন্ত্রের সর্বশেষ (২০২২ সালের) সংশোধনী অনুযায়ী বিসিবির ১৮৯ কাউন্সিলরের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবের প্রতিনিধি ৭৬ জন। বাকিরা আসেন জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা এবং বিভিন্ন কোটায়।

জেলা ও বিভাগের কাউন্সিলররা রাজনৈতিক বিবেচনায় আসেন বলে তাঁদের ভোট ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই থাকে। বিসিবির নির্বাচনে মূল তারতম্যটা তাই গড়ে দিতে পারতেন ক্লাব কাউন্সিলররা।

প্রায় সব ক্লাবকেই নিজেদের ছায়াতলে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার পরই অবশ্য সবাইকে সমান কাউন্সিলরশিপ দেওয়ার নিয়ম হয়। নইলে ২০২২ সালের আগপর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগ থেকে শীর্ষ ৬ দল পেত ২টি করে কাউন্সিলরশিপ, অন্য দলগুলো ১টি করে। এভাবে ঢাকার অন্যান্য লিগেও কাউন্সিলরশিপ নির্ধারিত ছিল। ভোট নিশ্চিত রাখতে নিজেদের ক্লাবগুলোকে পয়েন্ট তালিকার ওপরের দিকে রাখাটা জরুরি ছিল তখন।

ঢাকার ক্রিকেটে পাতানো ম্যাচ এবং পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে বিসিবির বিরুদ্ধে
ঢাকার ক্রিকেটে পাতানো ম্যাচ এবং পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে বিসিবির বিরুদ্ধে

নাজমুল হাসানের বোর্ড সেই নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে ঢাকার ক্রিকেটে ছড়িয়েছে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের বিষবাষ্প, পাতানো ম্যাচের ভাইরাস। ক্রিকেটাররা মাঠে যতই শিরোপা জয়ের জন্য খেলুন না কেন, মাঠের বাইরে থেকে তাঁদের দিয়ে খেলানো হতো আসলে ক্ষমতার খেলা।

‘ভালোবাসা’র ক্রিকেটে নিজেদের ‘অজেয়’ রাখার ক্ষমতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *