৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প সিলেটে আলোচনায় ফয়সল

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে:
সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে নতুন সারকারখানা নির্মাণকালীন সময়ে দুর্নীতির মূল কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন আলোচিত স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ডিএম ফয়সল। প্রথমে তিনি ব্যবসায়ী হলেও পরে শ্রমিক লীগ নেতার আড়ালে স্থানীয় এমপি’র আস্থাভাজন হিসেবে দু’হাতে টাকা কামিয়েছেন। এখন তার বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। ৫ই আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর সিলেটের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে দুর্নীতি, প্রভাব বিস্তার সহ নানা ঘটনায় আলোচিত হচ্ছেন ডিএম ফয়সলের নাম। ফয়সল আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে তিনি মানতে নারাজ। ব্যক্তিগত কাজে দুবাইয়ে রয়েছেন বলে জানান। দেশের অন্যতম বড় শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরির অবস্থান সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। শেখ হাসিনা সরকারের মেয়াদের সময় পুরাতন সারখানার পাশে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি নির্মাণ করা হয়। নতুন করে ঢেলে সাজানো হয় সবকিছু।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি খাত হচ্ছে প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কারখানার অভ্যন্তরে ৪৫টি ভবন নির্মাণ করা হয়। অফিসারদের জন্য আরও ৯৮টি ভবন নির্মাণ হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে; এসব নির্মাণে দুর্নীতির মচ্ছব চালিয়েছেন ডিএম ফয়সল। নিজে কয়েকটি ভবনে কাজ করার পাশাপাশি প্রায় সবক’টি ভবনের কাজই হয়েছে সমঝোতার মাধ্যমে। ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার সমঝোতা করে ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিয়ে তিনি ৭০ থেকে ৭৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এর বাইরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে কমিশনও নিয়েছেন। এখন এই ভবনগুলোর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বসবাসকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। অনেক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। কোনো কোনোটিতে চুঁইয়ে পড়ছে পানিও। সারকারখানার সিভিল শাখার ডেপুটি চিফ বিকাশ ঘোষ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে মসজিদের ফাটল মেরামত করা হয়েছে। অন্যান্য ভবনের মেরামতের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। যখনই ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে তারা কাজ করছেন। এই ভবনগুলোর বয়স বেশিদিন হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এদিকে- ভবন নির্মাণে কাজ করেছিল কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তারা জানিয়েছেন- ৪৫টি ভবনের কাজ সমঝোতার মাধ্যমে হয়েছে। আর এই সমঝোতার মূল নায়ক ডিএম ফয়সল। সারকারখানা বাজার সংলগ্ন কলাবাগান এলাকায় তার বিলাসী অফিস ছিল। ওই অফিসে বসে সব কিছুই পরিচালিত হতো। সেখান থেকে কাজ পাইয়ে দেয়া, কমিশন আদায় করা, নতুন করে কাজ বাগিয়ে আনা সহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হতো। সমঝোতার টাকা রাখা হতো ফয়সলের কাছে। পরে ওই সব টাকা তিনি ঠিকাদারদের ফেরত দেননি। মেরিনা কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী হেমায়েত আহমদ জানিয়েছেন, তিনি এখনো প্রায় ১২ লাখ টাকা ডিএম ফয়সলের কাছে পাবেন। সে তার কোম্পানির নাম দিয়ে প্রথমে কাজ করে নিজেকে ঠিকাদার হিসেবে প্রস্তুত করেছেন। পরবর্তীতে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কিন্তু তার কোম্পানির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। সেভেন পাওয়ার কনস্ট্রাকশনের পরিচালক মাহবুবুল হক জানিয়েছেন- তিনি এখনো ৬ লাখ টাকা ফয়সলের কাছে পাবেন। একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে সকল কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে জিম্মি করে ফয়সল কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার দাপটের কাছে সবাই অসহায় ছিলেন। প্রথমে এমপি ও পরে দলীয় পদের জোরে সে এসব কাজ করেন। এ ছাড়া, রাহাত নামের আরও এক ঠিকাদারের ১১ লাখ টাকা এবং কমপক্ষে ১০-১২ জন ঠিকাদারের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। স্থানীয় সিবিএ’র শ্রমিকরা জানিয়েছেন; ফয়সল স্থানীয় এমপি’র আস্থাভাজন ছিলেন। এ কারণে ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরিকেন্দ্রিক সব জায়গাতেই তার প্রভাব ছিল। তার বিলাসী কার্যালয়ে এসে থানার ওসি সহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বসে আড্ডা দিতেন। একই সঙ্গে দুর্নীতির মামলায় ফেরারি আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হোসেন খোকন সহ কয়েকজন ছিলেন তার শেল্টারদাতা। সারকারখানাকেন্দ্রিক কাজে তারা অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতেন। শ্রমিক, কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- শাহজালাল সারকারখানার কাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন প্রায় ২ হাজার কোটি টাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ কামিয়েছে মেসার্স ফয়সল অ্যান্ড কোম্পানি ও মেসার্স মল্লিক অ্যান্ড ব্রাদার্স। তাদের মতে; ফয়সল দু’হাতে টাকা আয় করে সিলেট নগরে বাড়ি, ঢাকার মিরপুরে নিজস্ব অফিস ও বাড়ি এবং কানাডায় বাড়ি নির্মাণ করেছেন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন; ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে আবাসিক ভবন নির্মাণে একক আধিপত্য বিস্তার করে ফয়সল বাগিয়ে নিতে থাকেন একের পর এক কাজ। তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু কাজের অগ্রগতি দেখতে ফেঞ্চুগঞ্জ ছুটে আসেন। সারকারখানার ভিআইপি গেস্ট হাউজে বসে চুক্তি হয় শিল্পমন্ত্রীর এলাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মল্লিক অ্যান্ড ব্রাদার্সের সঙ্গে ডিএম ফয়সলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফয়সল অ্যান্ড কোম্পানির। ওই দুইটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় কাজ করে। শুধু কাজ নয় বলা যায় সারকারখানার সব কাজ বণ্টন এবং নিয়ন্ত্রণ হয় ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। শাহজালাল সারকারখানার উৎপাদন শাখা সূত্র জানায়- নবনির্মিত শাহজালাল সারকারখানা ২০১৫ সালে টেস্ট রানে যায়। ওই সময় চীনা প্রকৌশলীরা বেশ কিছুদিন ইউরিয়া সারের পরীক্ষামূলক উৎপাদন করে। শাহজালাল সারকারখানা দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৭৬০ টন। সারকারখানায় পরীক্ষামূলক ইউরিয়া সার উৎপাদন করা হয় ৩০ হাজার টনের অধিক। বিপুল পরিমাণের ওই সারের কোনো হিসাব ছিল না, কারণ ওইগুলো পরীক্ষামূলক উৎপাদন ছিল। বিদ্যমান ওই সারগুলো ফয়সল অনায়াসে বিক্রি করে দেয় বলে অভিযোগ উঠে। কারণ ওই সময় ফয়সল অ্যান্ড কোম্পানি ও মেসার্স মল্লিক অ্যান্ড ব্রাদার্স ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে সার পরিবহনের কার্যাদেশপ্রাপ্ত ছিল। প্রতি টন ইউরিয়ার বিক্রয় মূল্য ২০ হাজার টাকা হলে পরীক্ষামূলক উৎপাদিত ৩০ হাজার টন সার বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছে ৩০ কোটি টাকা। শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোপাল চন্দ্র জানিয়েছেন- নানা অনিয়ম, দুর্নীতির ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পূর্বের যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা এসব করেছেন। এখন অবশ্য সবকিছু নিয়ম মতো চলছে বলে জানান তিনি। ডিএম ফয়সলের বক্তব্য: ফেঞ্চুগঞ্জের ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি নির্মাণের সময় তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি বলে জানান স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ডিএম ফয়সল। বলেন- অন্যান্য ঠিকাদারের মতো তিনিও একজন ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছেন। এমপি’র নির্দেশে মূল সিন্ডিকেটে ছিলেন তার ভাতিজির জামাই সৈয়দ তৌফিকুল হাদী সহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা খোকন সহ কয়েকজন। তারাই মূলত এমপি’র শেল্টারে এসব করেছেন। তাকেও ওদের টাকা দিয়ে কাজ করতে হয়েছে। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা আমেরিকায় বসেও তার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা চাচ্ছে। আর পরীক্ষামূলক উৎপাদিত সার পরিবহনে তার প্রতিষ্ঠান জড়িত ছিল না। সেটি দুর্নীতি করেছে মেসার্স মল্লিক অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিকপক্ষ। এ কারণে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাকে কালো তালিকাভুক্ত করার পর তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। এ ছাড়া যেসব ভবনের কাজ হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই হয়েছে টেন্ডারের মাধ্যমে। সমঝোতায় কম সংখ্যক বিল্ডিংয়ের কাজ হয়েছে। ঢাকা কিংবা কানাডায় তার কোনো সম্পদ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *