ঠিক কোন ‘স্ট্যাটাসে’ এখন ভারতে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা?

সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি বিমান দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে ঠিক ১৫ দিন আগে। সেদিন (৫ অগাস্ট) সন্ধ্যায় ওই বিমানঘাঁটিতে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাকে স্বাগত জানান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।

তার পরদিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দেশের পার্লামেন্টে জানান, ভারত সরকারের কাছে শেখ হাসিনা ‘সাময়িকভাবে’ এ দেশে আসার অনুমোদন চেয়েছিলেন এবং তা মঞ্জুর হওয়ার পরই তিনি ভারতের মাটিতে পা রেখেছেন।
সেই থেকে শেখ হাসিনা এখনও পর্যন্ত ভারতেই রয়েছেন– এবং যতদূর জানা যাচ্ছে- দিল্লির উপকণ্ঠে একটি আধা-সামরিক বাহিনীর অতিথিনিবাস বা ‘সেফ হাউসে’ই দুই বোনকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে তাদের ঠিকানা কী, সেটা সরকারিভাবে কখনওই প্রকাশ করা হয়নি।

শেখ হাসিনা ঠিক কোন ‘ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসে’ ভারতে রয়েছেন, সে ব্যাপারেও এখনও পর্যন্ত ভারত সরকার সম্পূর্ণ নীরব রয়েছে।

অর্থাৎ তিনি কোনও বিশেষ ভিসায় ভারতে অবস্থান করছেন, না কি তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় (পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম) দেওয়া হয়েছে– এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকার রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত একটি শব্দও খরচ করেনি।

এই কারণেই প্রশ্ন উঠছে, ভারতে এই মুহূর্তে তার অবস্থানের অভিবাসনগত বৈধতাটা ঠিক কী এবং সেই স্ট্যাটাস কতদিন পর্যন্ত বৈধ থাকতে পারে?

এই প্রশ্নের যে জবাব পাওয়া গেছে তা এ রকম- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার যে ‘ডিপ্লোম্যাটিক/অফিসিয়াল’ পাসপোর্ট ছিল তা এখনও বৈধ এবং সেই পাসপোর্টের সুবাদে তিনি অন্তত দেড় মাস কোনও ভিসা ছাড়াই অনায়াসে ভারতে অবস্থান করতে পারেন।

ফলে যদি-না এর মধ্যে সেই পাসপোর্ট ‘রিভোকড’ বা প্রত্যাহার হয়, তাহলে এই সময়সীমার মধ্যে অন্তত ভারতে তার বর্তমান অবস্থান সম্পূর্ণ আইনসম্মত, ভারতের এ ক্ষেত্রে আলাদা করে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রয়োজনও নেই।

ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, শেখ রেহানার ক্ষেত্রে অবশ্য এই জটিলতাটুকুও নেই, কারণ তিনি ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্যের পাসপোর্টধারী– ফলে সাধারণ ‘ভিসা অন অ্যারাইভালে’ই (ভারতের মাটিতে পা রাখার পর ব্রিটিশ নাগরিকদের যে ভিসা মঞ্জুর করা হয়) তিনি কার্যত যতদিন খুশি ভারতে থাকতে পারেন।

শেখ হাসিনার ভারতে বর্তমানের অবস্থানের ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত বিষয়টিকেই এই প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ভারত সরকার যা বলছে

গত ১৬ আগস্ট বিকালে দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে নির্দিষ্ট প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল।

সেদিন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, “প্রায় দু’সপ্তাহ হল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে অবতরণ করেছেন। আপনি কি আমাদের বলতে পারেন তার এই অবস্থানের (ইমিগ্রেশন-গত) স্ট্যাটাসটা কী … অর্থাৎ তিনি কি নিয়মিত ভিসায় এ দেশে আছেন? না কি তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন? না কি তাকে কোনও ধরনের গৃহবন্দি বা অন্তরীণ অবস্থায় (ডিটেনশনে) রাখা হয়েছে?”

“প্রশ্নটা এই কারণেই করা, যে আমরা নানা ধরনের পরস্পরবিরোধী সংকেত পাচ্ছি। তার কন্যা (সায়মা ওয়াজেদ পুতুল) টুইট করেছেন যে, তিনি মা-র সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। আবার এর পাশাপাশি, আমেরিকায় অবস্থানরত তার ছেলের (সজীব ওয়াজেদ জয়) মাধ্যমে শেখ হাসিনা বিবৃতিও জারি করেছেন। ফলে শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানের প্রকৃত স্ট্যাটাস নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরির অবকাশ হচ্ছে, তার বদলে ভাল হয় যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের জানায় ঠিক কোন শর্তের অধীনে তিনি এ দেশে রয়েছেন।”

যে সাংবাদিক এই প্রশ্নটি করেছিলেন, তিনি শেখ হাসিনাকে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। মুখপাত্র কিন্তু তার জবাব দেওয়ার সময় প্রথমেই স্পষ্ট করে দেন, তিনি ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’কে নিয়ে কথা বলছেন!

রণধীর জয়সওয়াল তখন বলেন, “আমরা গত সপ্তাহেও এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিলাম যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভারতে আসার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছিল খুব স্বল্প সময়ের নোটিসে।”

“এই পরিস্থিতি এখনও ক্রমাগত পাল্টাচ্ছে। এই মুহূর্তে অন্তত তার (শেখ হাসিনার) পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের নতুন করে কিছু জানানোর নেই”, বলেন তিনি।

১৬ আগস্ট মুখপাত্রের এই বক্তব্য ছিল ঠিক তার দশদিন আগে (৬ অগাস্ট) পার্লামেন্টে করা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বক্তব্যের হুবুহু প্রতিধ্বনি।

সেদিন জয়শঙ্কর সভায় জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর “খুব অল্প সময়ের নোটিসে তখনকার মতো (‘ফর দ্য মোমেন্ট’) ভারতে আসার জন্য অনুমোদন (‘অ্যাপ্রুভাল’) চান। একই সঙ্গে (শেখ হাসিনার বিমানের জন্য) ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্সের অনুমতিও চাওয়া হয় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি বর্ণনা করার জন্য জয়শঙ্কর সেদিনও এই পরিবর্তনশীল শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।

ভারতের সরকারি অবস্থানে যে মাঝের এই কয়েকদিনে এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি, তা এই ধরনের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট।

জবাব ‘সংশোধিত ট্র্যাভেল অ্যারেঞ্জমেন্টে’?’

সুতরাং এরপরও মূল প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, তাহলে শেখ হাসিনা ভারতে এই মুহুর্তে ঠিক কীসের ভিত্তিতে আছেন?

দিল্লিতে একাধিক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা আভাস দিয়েছেন, ভারতে শেখ হাসিনার এই মুহুর্তে অবস্থানের ভিত্তিটা হল ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘সংশোধিত ট্র্যাভেল অ্যারেঞ্জমেন্ট’।

দুই দেশের শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি সরকারের মধ্যে ঢাকাতে এই সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই।

ভারতের পক্ষে ওই সমঝোতাপত্রে সই করেছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন বিশেষ সচিব (বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) ব্রজরাজ শর্মা। আর বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষরকারী ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা পরিষেবা বিভাগের তখনকার সচিব ফরিদউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।

প্রাথমিকভাবে পাঁচ বছর মেয়াদী এই সমঝোতাটি তারপর নিয়মিত ব্যবধানে নবায়ন করার কথা, যা এ বছরের গোড়ার দিকে করাও হয়েছে।

ওই সমঝোতাপত্রের ১(এ) ধারাতেই পরিষ্কার উল্লেখ করা আছে, উভয় দেশের ডিপ্লোম্যাটিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের ৪৫ দিনের মেয়াদে ভিসা ছাড়াই বসবাসের জন্য (‘ভিসা ফ্রি রেজিম’) থাকতে দিতে দুই দেশ পারস্পরিকভাবে রাজি হয়েছে।

অর্থাৎ এই সমঝোতা অনুযায়ী বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাটিক/অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীরা ভারতে ভিসা ছাড়াই ৪৫ দিন থাকতে পারবেন– আবার অন্যদিকে ভারতের ওই বিশেষ ধরনের পাসপোর্টধারীরা বাংলাদেশেও ঠিক একই সুবিধা পাবেন।

প্রসঙ্গত, রাষ্ট্র বা সরকারের যে পদাধিকারীদের কূটনৈতিক বা সরকারি কোনও প্রয়োজনে বিদেশে সফর করতে হয়, তাদেরই এই ‘ডিপ্লোম্যাটিক’ বা ‘অফিসিয়াল’ বা ‘সার্ভিস’ পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়ে থাকে।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়ে শেখ হাসিনা যখন দেশত্যাগ করেন, তার ডিপ্লোম্যাটিক/অফিসিয়াল পাসপোর্ট কিন্তু সম্পূর্ণ বৈধ ছিল– যেকোনও কারণেই হোক তা কিন্তু বাতিল করা হয়নি।

বাংলাদেশে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও তা বাতিল করেছে বলে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনও খবর নেই।

ফলে যতদিন সেই পাসপোর্ট বহাল থাকছে, তার ভিত্তিতেই দু’দেশের মধ্যেকার সমঝোতা অনুযায়ী তিনি টেকনিক্যালি কোনও ধরনের ভিসা ছাড়াই ৪৫ দিন ভারতে অবস্থান করতে পারবেন– যার মধ্যে মাত্র ১৫ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে।

ভারত সরকারের একটি সূত্র আরও জানিয়েছে, শুধু বাংলাদেশই নয়– ডিপ্লোম্যাটিক ও অফিসিয়াল/সার্ভিস পাসপোর্টধারীরা যাতে বিনা ভিসায় একে অন্যের দেশে থাকতে পারেন, সেজন্য মোট ১০০টি দেশের সঙ্গে ভারতের একই ধরনের সমঝোতা আছে।

শুধু ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টধারীদের জন্য অনুরূপ সমঝোতা আছে আরও ৩৪টি দেশের সঙ্গে।

বিনা ভিসায় থাকার এই মেয়াদ কোনও দেশের ক্ষেত্রে ৯০ দিন, কোথাও বা ৪৫, ৩০ কিংবা ১৪ দিন। ভারত-বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি ৪৫ দিন।

কিন্তু এই দেড় মাসের মধ্যে যদি শেখ হাসিনার বর্তমান পাসপোর্ট ‘রিভোক’ বা বাতিল করা হয়, তাহলে ভারতের কী করণীয় আছে?

“সেটাও বড় কোনও সমস্যা নয়, কারণ এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের ‘প্ল্যান বি’ বা ‘প্ল্যান সি’ প্রস্তুত রাখতেই হয়, এখানেও নিশ্চয়ই সেটা তৈরি আছে”, জানান দিল্লির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা। সূত্র: বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *