মাহফুজ শাকিল : মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার আলোচিত স্কুল ছাত্রী নাফিছা জান্নাত আনজুম (১৫) হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। নিহত আনজুমকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলেন জুনেল মিয়া (৩৯) নামের প্রতিবেশী এক যুবক। আনজুম সেই প্রেমের প্রস্তাব মেনে নেননি। প্রেম এবং ধর্ষণ চেষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে ক্ষুব্দ হয়ে আনজুমকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে লাশ ছড়ায় ফেলে রাখেন ঘাতক জুনেল। ১৮ ঘন্টা পর হত্যা মামলার মূল রহস্য উদঘাটন ও আলামত উদ্ধার করেছে পুলিশ। ১৬ জুন সোমবার দুপুরে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের কনফারেন্স হলে প্রেস ব্রিফিং করে এমন তথ্য জানান জেলা পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, আসামি জুনেলের দেখানো মতে এবং পুলিশের তল্লাশীকালে হত্যাকান্ডের আশেপাশে বিভিন্ন স্থানে ফেলে রাখা নিহত আনজুমের পরিহিত বোরকা, স্কুল ব্যাগ, বই ও একটি জুতা উদ্ধার করে পুলিশ। ঘাতক জুনেল কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামের বাসিন্দা জাহির মিয়ার ছেলে। তিনি পেশায় দিনমজুর। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রয়েছে। জুনেল ও আনজুমের বাড়ি পাশাপাশি। তিনি আরো বলেন, গত ১২ জুন সকাল ৭টায় সিংগুর গ্রামে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হয় নিহত আনজুম। এ বিষয়ে আনজুমের মা নাসিমা আক্তার গত শুক্রবার কুলাউড়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এর দুই দিন পর ১৪ জুন বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটে বাড়ির পাশের ছড়ার পাশে দুর্গন্ধ পেয়ে নিহত আনজুমের ভাই ও মামা অর্ধগলিত মরদেহটি খুঁজে পান এবং পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে লাশের সুরতহাল প্রস্তুত করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করে। এ ঘটনায় থানায় নিহতের মা বাদী হয়ে ১৫ জুন থানায় অভিযোগ দিলে সেটি হত্যা মামলা হিসেবে রুজু করা হয়। ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস) নোবেল চাকমা, কুলাউড়া সার্কেলের (অতিঃ দায়িত্বে) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আজমল হোসেন, কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ গোলাম আপছার, পুলিশ পুরিদর্শক সুদীপ্ত ভট্টাচার্যসহ একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। দ্রুততম সময়ে ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য জেলা পুলিশ ও কুলাউড়া থানা পুলিশের সদস্যদের নিয়ে কয়েকটি বিশেষ টিম গঠন করে আশেপাশের ব্যাপক তল্লাশী করা হয়।
পুলিশ সুপার আরো জানান, ঘাতক জুনেল মিয়া খুবই খারাপ ও চরিত্রহীন লোক। এলাকায় তার সম্পর্কে স্থানীয় লোকের তথ্যমতে খোঁজ নিয়ে তাকে প্রথমে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়। এরআগেও আরো ছয়-সাতটি ঘটনা এলাকায় সে ঘটিয়েছে। এলাকার স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের সে প্রায়শই উত্যক্ত করতো। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়ভাবে একাধিক সালিশও হয়েছে। লোকলজ্জার ভয়ে অনেক ঘটনা প্রকাশ্য আসেনি। নিহত আনজুম প্রতিদিন প্রাইভেট পড়ার জন্য সকালে বাড়ি থেকে বের হতো। সেই সুযোগ কাজে লাগাতো ঘাতক জুনেল। এমনকি সে নিহত আনজুমের আরেক সহপাঠীকে গত তিনদিন থেকে রাস্তায় যাওয়া আসার পথে উত্যক্ত করেছে। জুনেলের স্ত্রী বাড়িত না থাকায় সেই সুযোগে আনজুমকে ঘটনার দিন ধর্ষণ করার চেষ্টা করে ঘাতক জুনেল। একপর্যায়ে আনজুম চিৎকার দিলে তাকে গলা চেপে হত্যা করে একটি ছড়ায় তাকে ফেলে রেখে যায়। এই ঘটনার সাথে আরো কেউ জড়িত কিংবা অন্য কোন ঘটনা আছে কিনা সেটা পুলিশের অধিকতর তদন্তে বের হবে।
জেলা পুলিশ জানায়, শুধু স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষ ৬টি টিম গঠন করা হয়। স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য, আলামত উদ্ধারের জায়গা এবং নারী ঘটিত কিছু বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্টতা দেখে সন্দেহ হওয়ায় পুলিশ ঘাতক জুনেল মিয়াকে আটক করে। পরবর্তীতে তার মোবাইল চেক করে পর্ণ সাইটে ব্রাউজিং এর তথ্য দেখে পুলিশের সন্দেহ আরও বাড়ে। পরবর্তীতে পুলিশ তাকে দুপুর থেকে রাত প্রায় ১২ টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সে পুলিশ সুপারের সামনে রাত ১২ টার দিকে হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে।
ঘাতক জুনেল পুলিশের কাছে জানায়, নিহত আনজুম তার বাড়ির সামনের একটি রাস্তা দিয়ে প্রায়ই স্কুল ও প্রাইভেটে আসা যাওয়া করত। সেই সুবাদে আনজুমের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করে জুনেল। ঘটনার দিন গত ১২ জুন নিহত আনজুম পাশের গ্রামে প্রাইভেট পড়া শেষে আসামী জুনেল মিয়ার বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে ফেরার পথে সকাল অনুমান সাড়ে দশটায় আসামী জুনেল শিক্ষার্থী আনজুমের সাথে কথা বলতে বলতে তার পিছু নেয়। আনজুম বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলে জুনেল মিয়া তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তখন আনজুম চিৎকার করলে জুনেল তার হাত দিয়ে গলায় চাপ দিয়ে ধরলে আনজুম ঘটনাস্থল কিরিম শাহ মাজারের মধ্যের রাস্তায় অচেতন হয়ে পড়ে। এরপর আনজুমকে মোকাম সংলগ্ন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ছড়ার পাড়ে ঝোপে ফেলে রাখে ঘাতক জুনেল। মোকামের মাঠে পড়ে থাকা আনজুমের স্কুল ব্যাগ ও একটি জুতা ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী ঘন ঝোপে ফেলে দেয় এবং আনজুমের পরিহিত বোরকাটি নিকটবর্তী কিরিম শাহ মাজারের উত্তর পাশে জনৈক রওশন আলী গং’য়ের পারিবারিক কবরস্থানের সীমানা বাউন্ডারী পার করে ছুড়ে ফেলে দেয়। পুলিশ ঘাতক জুনেলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রবিবার দিবাগত রাতে স্থানীয় লোকজন ও সংবাদকর্মীদের উপস্থিতিতে নিহত আনজুমের সেই বোরখা উদ্ধার করে।
প্রসঙ্গত, ১৪ জুন শনিবার বিকেলে নাফিছা জান্নাত আনজুমের বাড়ির পাশে একটি ছড়ার পাড়ে ঝোপ থেকে তার লাশ উদ্ধার কওে পুলিশ। এর আগে ১২ জুন বৃহস্পতিবার সকালে আনজুম স্থানীয় কোচিং সেন্টারে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে আর বাসায় ফিরে আসেনি। এ ব্যাপারে নিহত আনজুমের মা নাছিমা আক্তার বাদী হয়ে ১৫ জুন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। নিহত আনজুম উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের শেরপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালিকের মেয়ে এবং স্থানীয় শ্রীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এদিকে শিক্ষার্থী আনজুম হত্যার প্রতিবাদে এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ১৫ জুন রবিবার বিকেলে শ্রীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী।
