‘হায় হোসেন হায় হোসেন’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত  কুলাউড়ার পৃথিমপাশার ইমামবাড়া

বিশেষ প্রতিনিধি:

‘হায় হোসেন হায় হোসেন’ মাতমে নিজ শরীর রক্তাক্ত করে মাতমে সরব  কুলাউড়ার পৃথিমপাশার ইমামবাড়াগুলো।

১৭ জুলাই বুধবার আশুরা উপলক্ষে উপজেলার লংলা পরগনার পৃথিমপাশা নবাববাড়ি সহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার ইমামবাড়ায় শিয়া মতাবলম্বীরা পবিত্র মহরম উপলক্ষে ইমাম হোসাইন (আ:) ও কারবালার শহীদদের স্মরণে মজলিশ, মাতম, মর্সিয়া, জারি, নোহা, শোক মিছিলের মাধ্যমে মহরম পালন করেছেন। ১০ মহরম দেশের বিভিন্ন স্থানের ন্যায় ধর্মীয় ভাবগাম্বীর্য ও নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে কুলাউড়ার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের নবাব বাড়িতে পবিত্র আশুরা পালিত হয়। বুধবার বিকেল ৪টায় নবাব বাড়ির হোসেনী দালান থেকে বের হয় সু-সজ্জিত তাজিয়া মিছিল। শিয়া সম্প্রদায়ের প্রায় সহস্রাধিক পুরুষ নানা অনুষঙ্গ, তাজিয়া, কালো, লাল ও সবুজ নিশান উড়িয়ে মিছিলে অংশ নেয়। খালি পায়ে মিছিলে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা শোকের প্রতীক কালো পোষাক পরিধান করে।

দীর্ঘ সাড়ে তিনশত বছর ধরে বৃহত্তর সিলেটের নবাব আলী আমজদের পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি বিজড়িত এই নবাব বাড়িতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। মহরমকে কেন্দ্র করে নবাববাড়ির আশপাশের এলাকায় লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়েছে। বসানো হয়েছে ভাসমান প্রায় দুই শতাধিক দোকান-পাট। দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকেও শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আশুরা উপলক্ষে এখানে ছুটে এসেছেন। প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে নবাব বাড়িতে। পহেলা মহরম থেকে দশ মহরম পর্যন্ত পৃথিমপাশা নবাব বাড়ীর ইমামবাড়া, তরফি সাহেব বাড়ী, ছোট সাহেব বাড়ী, মরহুম শাহাদাত হোসেনের বাড়ী, বাঘ বাড়ী, মনরাজ সাহেব বাড়ী, পাল্লাকান্দি সাহেব বাড়ী প্রমুখ ইমাম বাড়াগুলোতে মহরম ও কারবালার ইতিহাস স্মরণে মজলিশ, মাতম, নোওহা, জিয়ারত, দোয়া, জারি অনুষ্ঠানাদি হয়।

মহরমের শোক অনুষ্ঠান ও আশুরা পালনের জন্য পৃথিমপাশা নবাব বাড়ির ইমামবাড়া গুলো থেকে বুধবার বিকেল ৪টায় নবাব বাড়ির হোসেনী দালান থেকে তাজিয়া মিছিলসহ ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ ধ্বনিতে শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীরা নিজের শরীর রক্তাক্ত করে মিছিলটি আলী আমজদ স্কুল এন্ড কলেজের সম্মুখে রবির বাজার পদ্মদিঘির পার স্থানীয় কারবালা প্রান্তরে (কবরস্থানে) গিয়ে সমবেত হয়। সেখানে মহরমের সেই বিষাদময় দিনে ইমাম হোসেনের করুন মৃত্যুর প্রতিবাদে ‘হায় হোসেন হায় হোসেন’ মাতম করে আবারও নিজের শরীর রক্তাক্ত করে কারবালার শোকে শোক পালন করেন। কালো জামা রক্তে ভিজে চুপসে গেছে আর সাদা জামা হয়ে উঠে রক্তে রঞ্জিত। তবুও হায় হোসেন, হায় হোসেন, ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছে নবাব বাড়ির আকাশ-বাতাস। তাজিয়া মিছিলে বুক চাপড়ে, জিঞ্জির দিয়ে শরীরে আঘাত করে প্রকাশ করা হয় মাতম। কেউ আবার ধারালো ছোরাগুচ্ছ দিয়ে নিজ শরীর ও মাথা রক্তাত্ব করতে দেখো যায়। পৃথিমপাশার শিয়া অনুসারীরা জানান, মিছিলের শুরুতেই দুটি কালো গম্ভুজ বহন করা হয় বিবি ফাতেমার স্মরণে। এছাড়াও মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন নিশান নিয়ে আসেন। যে যার মতো এই নিশান বহন করেন। মিছিলের মধ্যে হায় হোসেন, হায় হোসেন করে শোকের গান গাওয়া হয় সমবেত কন্ঠে। এছাড়াও অনেকেই বুক চাপড়ে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ বলে মাতম করতে থাকেন। আশুরার দিনে তাজিয়া বের করা হয় শোকের আবহে। মূলত ইমাম হোসেন (রা.) এর সমাধির প্রতিকৃতি নিয়ে এই মিছিল হয়। তাজিয়া মিছিলের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, কারবালার শোককে ধারণ করে এ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মাতম করে শোক প্রকাশ করি সবাই। এদিকে নবাব বাড়িতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক স্থরের নিরাপত্তা চাদরে বেষ্টনি তৈরি করা হয়। অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠা ঐতিহ্যবাহি নবাববাড়িতে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রাখা হয়। স্পর্শকাতর জায়গা মোতায়েন করা হয় বিভিন্ন থানার পুলিশসহ অতিরিক্ত পুলিশ ও গ্রাম পুলিশ। সব-রকমের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুরো নবাব বাড়ি জুড়েই পুলিশ, ডিবি পুলিশ এবং গোয়েন্দা পুলিশ প্রস্তুত ছিলো বলে জানা গেছে।

মহরম অনুষ্ঠানের মোতাওয়াল্লী ও সাবেক তিন বারের সংসদ সদস্য এ্যাড. নওয়াব আলী আব্বাছ খাঁন বলেন, আজকের এই দিনটির আমাদের জন্য অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। এই দিবসটি আমাদের বাড়ির ঐতিহ্য। দীর্ঘ সাড়ে তিনশত বছরের অধিক সময় থেকে পৃথিমপাশায় মহরমের শোক অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এখানে শিয়া, সুন্নি ও অন্যান্য মতাবলম্বীদের সার্বিক সহযোগিতায় প্রতিবছরের ন্যায় এবারও আশুরার শোক পালন করা হয়। এদিকে শান্তিপূর্ণভাবে আশুরা পালিত হওয়ায় নবাব বাড়ির পক্ষ থেকে প্রশাসনসহ সর্বস্তরের জনসাধারণের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *