অনলাইন ডেস্ক : ছাত্র-জনতার আন্দোলন কেন্দ্রিক মামলায় অভিযুক্তদের নাম নিয়ে দ্বিধায় আছে পুলিশ। গণহারে গ্রেফতার ও অভিযুক্ত করার বিষয়ে বাড়তি সতর্ক বার্তা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দায়ের করা হত্যা ও অন্য মামলায় প্রাথমিক তদন্তে কোনো আসামির সম্পৃক্ততা না পাওয়া গেলে তার নাম প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সঠিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এসব মামলায় কোনো সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীকে গ্রেফতার না করতে বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, হত্যাকান্ডের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এতে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় না তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত নয় এমন অনেক ব্যক্তির নাম আসায় সঠিক বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনায় পড়েছে পুলিশ। ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা নিয়ে যথাযথ যাচাইয়ে গুরুত্ব দিতেই এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও নতুন করে মামলা নেওয়া ও গ্রেফতারের ক্ষেত্রেও প্রভাবিত না হয়ে প্রাথমিক প্রমাণে জোর দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির প্রথম সভায় সিদ্ধান্তের পর গত ৮ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়। পরে ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সব ইউনিটকে ওই চিঠি দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (কনফিডেন্সিয়াল) মো. কামরুল আহসান এর স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির প্রথম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শাহাদাত বরণকারী পরিবার বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বিভিন্ন আদালত বা থানায় দায়ের করা মামলায় সঠিক তথ্য প্রমাণ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীকে গ্রেফতার করা যাবে না।
এছাড়াও জুলাই-আগস্ট ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানকেন্দ্রিক দায়েরকৃত হত্যাকা- ও অন্যান্য মামলায় তদন্তপূর্বক কোনো কর্মকর্তা বা ব্যক্তির সম্পৃক্ততার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া না গেলে তাদের নাম প্রত্যাহারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে এই সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে আগামী ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন আকারে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (কনফিডেন্সিয়াল) মো. কামরুল আহসান গণমাধ্যমকে জানান, পুলিশ আগে যেভাবে কাজ করেছে ভবিষ্যতে যেন সেভাবে কাজ না করে। আমরা একটি প্রফেশনাল পুলিশিং চাই, যাতে কোনো ত্রুটি না থাকে। এজন্য আইনে এ সংক্রান্ত বিষয় থাকার পরও যথাযথ গুরুত্ব দিতে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এরই ধারাবাহিকতায় উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে গণহারে মামলার বিষয়ে কাউকে হয়রানি করা হবে না বলে আশ্বাসও দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। পরে বৈঠকে দুটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
এদিকে অনেক মামলায় গণহারে বিভিন্ন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বাঁধা প্রদান, ককটেল সাদৃশ্য বস্তু নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থীদের মারধর করার অভিযোগ এনে ৬ইউপি চেয়ারম্যানসহ ৮৩ জন নেতাকর্মীর নামে বিস্ফোরক আইনে গত ২৪ আগস্ট উপজেলার কাদিপুর ইউনিয়নের কুদ্দুস মিয়া ওরফে কালা মিয়ার ছেলে পারভেজ মিয়া মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের ৫দিন পর ২৯ আগস্ট তিনি উক্ত মামলা থেকে পাঁচ ইউপি চেয়ারম্যানসহ ৪৫ জন নেতা কর্মীর নাম বাদ দিতে কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ বরাবরে একটি আবেদন করলে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া পারভেজ মিয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে কোন ভাবেই সম্পৃক্ত নয় বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা কুলাউড়ার সমন্বয়করা ও বিএনপির নেতারা মামলার বাদীর সাথে তাদের দলের সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেছেন।
একাধিক সূত্রের মতে, এ মামলার পেছনে গত ইউপি নির্বাচনে পরাজিত এক চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক কয়েক ব্যক্তির ইন্ধন রয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। মামলা দায়েরের পর বাদী ও আসামীদের নাম নিয়ে স্থানীয় বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মমদুদ হোসেন, ভাটেরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ একেএম নজরুল ইসলাম, হাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়াদুদ বক্স, কুলাউড়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোছাদ্দিক আহমদ নোমান, কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম আজাদসহ ৪৫জন নেতাকর্মীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য থানায় আবেদন করেন বাদী পারভেজ মিয়া।
এর আগে পারভেজ মিয়া মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, গত ১৮ জুলাই সকাল ১১টার পর কুলাউড়া পৌর শহরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে সংহতি জানিয়ে স্লোগান দিলে মামলার প্রধান আসামিসহ অন্যান্যদের নির্দেশে শহরের মিলিপ্লাজার সামনে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ককটেল সাদৃশ্য বস্ত নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থীসহ তাকে মারধর করে।
কিন্তু গত ২৯ আগস্ট থানায় জমা দেয়া অব্যাহতি পত্রে বাদী পারভেজ মিয়া উল্লেখ করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ৫ আগস্ট পরিস্থিতির ঘটনা উল্লেখপূর্বক বিস্ফোরক আইনে তিনি একটি মামলা দায়ের করেন। উক্ত মামলায় আসামীদের নামের তালিকা তাড়াহুড়া করে প্রস্তুতের সময় কয়েকজন বিবাদীর নাম-ঠিকানা জানা থাকার কারণে এজাহারে উল্লেখ করেন। ৪৫ জন বিবাদীর নাম লোকমূখে শুনে এজাহারে উল্লেখ করলেও প্রকৃতপক্ষে ইউপি চেয়ারম্যানসহ ওই ৪৫জন বিবাদী মামলায় আনীত অভিযোগের সাথে জড়িত নন। তারা বিজ্ঞ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেতে তার কোন আপত্তি নেই।
মামলার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাদী পারভেজ মিয়া বলেন, গত ইউপি নির্বাচনে আমার বাড়িঘরে হামলা করার কারণে ১৫-১৬ জনকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে কয়েকজন ব্যক্তি আমার স্বাক্ষর নিয়ে ওই মামলায় ৮৩ জনকে সম্পৃক্ত করে। ওই মামলার বিষয়ে আমি কিছু জানিনা এমনকি অনেক ইউপি চেয়ারম্যানকেও ওই মামলায় জড়ানো হয়েছে পরে সেটি আমি জেনেছি। আমাকে নিয়ে একটি মহল অনেক গেইম খেলছে। মামলার পর থেকে আমিসহ আমার পুরো পরিবার নানা চাপ ও হয়রানির মধ্যে পড়েছে। না জেনে না বুঝে নির্দোষ মানুষকে মামলায় আসামী করা হয়েছে মামলার এজাহার দেখার পর নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হয়েছে। এখন আমার একটাই চাওয়া, আমার কারণে যাতে কোন নিরপরাধ মানুষ মামলা হয়রানির শিকার না হয়। আমি তাদেরকে মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য পুলিশের কাছে আবেদন দিয়েছি।
মামলার বিষয়ে ভাটেরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ একেএম নজরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ৮ বছর ধরে আমি আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে কোনটাসা ছিলাম। আমি আমার পরিষদের দায়িত্ব আর ব্যবসা বাণিজ্য ব্যতিত রাজনৈতিক কোন কর্মকান্ডে বিন্দুমাত্র জড়িত ছিলাম না। আমার উপরে মামলা হয়েছে শুনে আমি মামলার বাদীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তখন বাদী বলেছে, সে আমাকে চিনে না আমার নাম মামলায় সে অন্তর্ভুক্ত করে নাই কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সে বলতে পারবেনা। বাদী পারভেজ মুঠোফোনে আরও জানায়, ১৮ জুলাই কোন ঘটনা ঘটেনি। সে ওই দিন কুলাউড়ায় ছিল না, ঢাকায় ছিল। এছাড়া সে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলনা বলে জানায়।
ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মমদুদ হোসেন, হাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়াদুদ বক্স ও কুলাউড়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোছাদ্দিক আহমদ নোমান জানান, তারা চলমান পরিস্থিতিতে কোন মিছিলে সম্পৃক্ত না থাকলেও তাদের এই মামলায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হয়রানি করার জন্য আসামী করা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই মামলা থেকে তাদের অব্যাহতির দাবি জানান। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কে কোন দল করে সেটা আমাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় ছিলনা। সাধারণ মানুষকে তাঁর নায্য সেবাটুকু দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।