নগ্ন করে ২৫ বছর মেয়েকে বন্দি করে রাখেন মা!

ডেস্ক রিপোর্ট : ফ্রান্সের পইতিয়েরস শহরের অন্যতম সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন ব্লাশ মন্যিয়ের। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তাঁর সৌন্দর্যের খ্যাতি ফ্রান্সের ছোট্ট শহর ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় দূরদূরান্তে। একাধারে অসম্ভব রূপবতী ও গুণবতী অভিজাত পরিবারের কন্যাসন্তান। এমন পাত্রীকে জীবনসঙ্গিনী করার জন্য যে শয়ে শয়ে প্রস্তাব আসবে তা বলাই বাহুল্য।

বিবাহযোগ্যা সুন্দরী পাত্রীর জন্য সুযোগ্য পাত্রের খোঁজ চালাচ্ছিলেন মন্যিয়েরের মা ও দাদা। ১৮৭৯ সালে ব্লাশ মন্যিয়েরের পিতা এমিল মন্যিয়েরের মৃত্যুর পর মা হয়ে ওঠেন পরিবারের কর্ত্রী।
সময়টা তখন ১৮৭৬ সাল। ২৭ বছরের ব্লাশ মন দিয়ে বসেন তাঁর থেকে বয়সে বেশ কিছুটা বড় এক আইনজীবীকে। সেই সম্পর্ক হয়তো মেনে নিতেন ব্লাশের মা। কিন্তু বাদ সাধল সেই আইনজীবীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা। ব্লাশের পরিবারের তুলনায় সেই পাত্রের অর্থনৈতিক অবস্থা নগণ্য। সে কারণে মেয়ের এই প্রণয় মেনে নিতে পারেননি মা।
এর পরই হঠাৎ করে শহর থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যান ব্লাশ। তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার কোনও চিহ্ন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বহু খোঁজাখুঁজি করে এক সময় হাল ছেড়ে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকে কাতর হয়ে পড়েন ব্লাশের মা। এক পর্যায়ে এসে তাঁকে ফিরে পাওয়ার সমস্ত আশা ত্যাগ করেন মা ও ভাই।
কালের নিয়মে এর পর কেটে যায় ২৫ বছর। যে আইনজীবীকে ব্লাশ ভালবাসতেন, তিনিও প্রেমিকা নিখোঁজ হওয়ার ১০ বছর পর মারা যান। সবাই প্রায় ভুলতে বসেছিলেন ডাকসাইটে সুন্দরী অভিজাত তরুণীকে। এমন সময় ব্লাশ পরিবারের নিস্তরঙ্গ জীবনে নেমে আসে ঝঞ্ঝা।
বিস্মৃত, অস্তিত্বহীন মানুষটির সন্ধান মিলল, তাও আবার একটি বেনামি চিঠির মাধ্যমে। ১৯০১ সালের এক সকালে ফ্রান্সের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে একটি চিঠি এসে পৌঁছয়। সে চিঠিতে প্রেরকের নাম বা ঠিকানা, কোনওটাই দেওয়া ছিল না। চিঠি তো না, যেন আস্ত একটা বোমা!
উড়ো চিঠিতে দাবি করা হয়েছিল নিজের বাড়ির একটি চোরকুঠুরিতে আটকে রাখা হয়েছে ব্লাশ মন্যিয়েরকে। ২৫ বছর ধরে প্রায় অনাহারে, নোংরা পরিবেশে নরকযন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। সংক্ষিপ্ত এই চিঠির বয়ান পড়ে চোখ কপালে উঠে যায় উপস্থিত সকলের।
চিঠিটি পড়ে সকলে হতবাক হলেও, এই চিঠি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি অনেকেরই। নিজের মেয়েকে কী ভাবে মা এইভাবে বন্দি করে রাখতে পারেন! মন্যিয়ের পরিবার ছিল ফ্রান্সের সবচেয়ে বনেদি পরিবারগুলোর অন্যতম। পইতিয়েরস শহরের উন্নয়নের জন্য প্রচুর অনুদান দেন স্বয়ং মাদাম মন্যিয়ের নিজে। তাই এই কাজ তাঁদের পক্ষে করা কার্যত অসম্ভব বলে মনে করেছিলেন তৎকালীন ফ্রান্সের অভিজাত সমাজের মাথারা।
বেনামি চিঠি হলেও সন্দেহ দূর করতে সরেজমিনে দেখতে মন্যিয়ের পরিবারে বাড়ি পরিদর্শনে আসেন পুলিশ আধিকারিকরা। তাঁরা তখনও জানতেন না অকুস্থলে গিয়ে কোন ভয়াবহ দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হবে।
মন্যিয়ের প্রাসাদে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমেই তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। এতেই পুলিশের সন্দেহ ঘনীভূত হয়। কয়েক জন আধিকারিক জোর করে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেন। খুঁজতে খুঁজতে উপরতলায় একটি তালাবদ্ধ ঘর তাঁদের নজরে আসে। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তাঁরা দরজার তালা ভেঙে সেই ঘরে প্রবেশ করেন।
ঘরটি ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার, বিশ্রি পচা গন্ধে দম আটকে আসার জোগাড়। ঘরের জানলা খোলার তোড়জোড় করে পুলিশ। সেই কাজও সহজসাধ্য ছিল না। পর্দায় মোটা পুরু ধুলো জমে ছিল, সেগুলি সরানোর পর দেখা গেল জানলার পাল্লা আটকে গিয়েছে। আলাদা আলাদা করে জানলা কেটে সেগুলি খোলার ব্যবস্থা করার হয়। ঘরে আলো প্রবেশ করতে যা দৃশ্য দেখলেন তাতে শিউরে উঠলেন পুলিশের কর্মকর্তারা।

নোংরা বিছানার এক কোণে পড়ে রয়েছে অস্থিচর্মসার এক দেহ, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়। নষ্ট হয়ে যাওয়া বিছানার উপর শুয়ে থাকা ওই নারীর সারা দেহ ছিল বিষ্ঠা এবং পচে যাওয়া খাবারে মাখা। বিছানার উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পোকামাকড় এবং খাবারের উচ্ছিষ্ট। লোক জনের উপস্থিতিতে শীর্ণ দেহ ঠকঠক করে কাঁপছিল। উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।
পচে যাওয়া খাবার এবং বিষ্ঠার দুর্গন্ধে বেশি ক্ষণ কেউ থাকতে পারছিলেন না। উদ্ধারকর্মীরা এর পর রুগ্ন দেহটিকে চাদরে মুড়িয়ে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। মাত্র ২৫ কেজি ওজনের কঙ্কালসার দেহটি নোংরা চুলে আবৃত ছিল যা আড়াই দশক ধরে কাটা বা ধোয়া হয়নি। ২৫ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ব্লাশকে দেখে চেনা ছিল অসম্ভব।
ব্লাশকে নিজের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে চাওয়ার মাশুল গুনতে হয়েছে এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করে। পরিবারের অমতে ভালবাসার জন্য অন্ধকার ঘরে দাম দিতে হয়েছে ২৫ বছর। তাও আবার সবচেয়ে কাছের মানুষ, নিজের মায়ের জন্য। দীর্ঘ ২৫ বছর এ শাস্তি ভোগ করেছিলেন ব্লাশ। এক সময় ব্লাশের দাদা বাধা দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের ব্যক্তিত্বের কাছে হার মানতে হয় তাঁকেও।
১৯০১ সালে যখন ব্লাশকে উদ্ধার করা হয়, সে সময়ে মাদাম মন্যিয়ের ছিলেন শারীরিক ভাবে দুর্বল। ব্লাশকে উদ্ধারের ১৫ দিনের মাথায় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সংবাদপত্রে বলা হয়েছিল, মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর অন্যায় স্বীকার করেন এবং কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেন।

দীর্ঘ দিনের বন্দিদশার কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ব্লাশ। স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারেননি তিনি। ১৯১৩ সালে এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *