হার না মানা হাওরবাসী

পলি রানী দেবনাথ : চায়ের দেশ হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজার জেলা। শুধু চা বাগান নয়,এ জেলায় রয়েছে তিনটি হাওরের অবস্থান। যেমন: হাকালুকি হাওর (কুলাউড়া ও বড়লেখা),কাউয়া দিঘি হাওর (রাজনগর),এবং হাইল হাওর (শ্রীমঙ্গল)। একসময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর ছিলো হাওরের চারপাশ,হাওরপাড়ের মুক্ত বাতাসে পাখিদের কলকাকলীতে পরিপূর্ণ থাকতো। বিস্তৃর্ণ ধানক্ষেতে দোলা দিয়ে যেত পুবালি হাওয়া। হাওড়ের নির্মল বাতাস, অবারিত জলরাশি, জলের বুক চিড়ে ছুটে চলা ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা ভাসিয়ে মাঝিরা গাইতো কোন মেস্তরী নাও বানাইলো, কেমন দেখা যায়—–কিন্তু একসময়ের সুখ, সমৃদ্ধ সে হাওর হারাতে বসেছে তার নিজ সৌন্দর্য্য। হাওর পাড়ের মানুষ যাদের জীবন জীবিকা সম্পূর্ণভাবে হাওরের উপর নির্ভরশীল তাদের প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতেহয় নানা প্রতিকূলতার। প্রায় প্রতি বছর অতিবৃষ্টি,অনাবৃষ্টি কিংবা আগাম বন্যায় ক্ষতির সম্মুখীন হন কৃষকরা। সুখ সমৃদ্ধিতে ভরা হাওর আজ বিলুপ্তির পথে। জীববৈচিত্র আর প্রাকৃতিক বিচারে পর্যটকদের সবচেয়ে আকর্ষনীয় জায়গা ছিলো হাওর অঞ্চল। কিন্তু সেই রূপ-সৌন্দর্য্য হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। এক সময়ের হীজল-তমাল গাছ,করচ,নলখাগড়াবিলুপ্তির পথে অনেকটাই। অবাধে কেটে নেয়া হচ্ছে গাছের ডালপালা। জ্বালানি হিসেবে সেগুলো ব্যবহার করেন হাওড় পাড়ের মানুষ। যার কারনে উজাড় হচ্ছে হাওরের ঘন সবুজ বনজঙ্গল।পাখির অভয়ারণ্য হাওড় অঞ্চল। প্রতি বছর হাজারো নানান প্রজাতির পরিযায়ী ও আবাসিক পাখির বিচরন করে সেখানে। পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয় চারপাশ,অসংখ্য চেনা অচেনা পাখির মনোমুগ্ধকর মেলায় আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে শীতকালে দেখা যায় বিরল প্রজাতির পাখিদের মিলনমেলা। কিন্তু এই পাখির সংখ্যা ক্রমশইকমছে। অনিরাপদ আবাসস্থল এবং পাখির খাদ্যের সংকটে কমছে পাখির সংখ্যা।ফসলে কীটনাশক দেওয়ার ফলে তা গিয়ে মিশছে পানিতে, ফলে মরছে মাছ আর কীটনাশক যুক্ত মাছ খেয়ে মারা যাচ্ছে পাখিরা ।ফলে দূগর্ন্ধযুক্ত হচ্ছে হাওরের পানি, সাথে সাথে হাওরের পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।
“মাছে ভাতে বাঙ্গালি” বাঙ্গালিদের চিরন্তন প্রবাদ।হাওর অঞ্চলের জলরাশিতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নানা জাতের মাছ।
যেমন-কৈ,সরপুটি,তিতপুটি,কাতলা,মাগুর,খৈলসা,বাঁশপাতা,আইড়,টেংরা,বাইম,চিতল প্রভৃতি। কিন্তু এই প্রজাতির মাছ কমছে দিন দিন। হাওর অঞ্চলের মানুষ এক সময় বলতো মাছ আর ধান হাওরের প্রাণ।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে হাওরের প্রাণ বিলীন হয়ে যাচ্ছে । কৃষকরা জমিতে ব্যবহার করেন কীটনাশক । আর এই কীটনাশকের ফলে মাছ মরছে প্রতিনিয়ত, এতে দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছ।
প্রতি বছর বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে হাওড় এলাকায় পর্যটকের ভীড় থাকে। ভ্রমন পীয়াসু মানুষ সুযোগ পেলেই ছুটে যান সেখানে। কিন্তু ভ্রমনের সময় পর্যটকরা নষ্ট করছেন জলাধার। পর্যটকরা তাদের ব্যবহৃত জিনিস যেমন- পলিথিন,ময়লা জিনিস,আবর্জনা,চিপস,চানাচুরের প্যাকেট যত্রতত্র ফেলে দেন।সেসব ময়লা আবর্জনায় হাওরের পানির দূষিত হচ্ছে। এতে হাওরের পানির স্বচ্ছতাও হারিয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ সকল জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন এলাকার সাধারন মানুষ। কাউয়াদিঘির হাওরের বাসিন্দা মোশাহিদ মিয়া জানান, হাওর এলাকার বড় বড় গাছ আগের মতো হয় না। পানিতে শেওলা,ঘাস না হওয়ার কারনে ধানের বীজতলায় পোকার সংক্রমন দেখা দেয়। আরেক বাসিন্দা জলাল মিয়া জানান, ইজারাদাররা শুকনোমৌসুমে জলাশয়,বিলে সেচে মাছ ধরেন। ফলে হাওরশুকিয়ে যায়,যার কারনে মা মাছ ডিম দিতে পারে না।
হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় হাওর এলাকায় পানি থাকে।প্রায় প্রতি বছরে বন্যায় ভেসে যায় কৃষকের পাকা ধান। সেই ধান পচে হাওরের পানি নষ্ট হয়।দীর্ঘ দিন হাওরের খাল ও ছড়া খনন না হওয়াতে ইতিমধ্যে অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে। থাকেনা পর্যাপ্ত পানি। এতে মুক্ত জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। হারাচ্ছে দেশীয় মাছ। ছোট ছোট অনেক বিল ভরাট হওয়ার কারনেঅনেকটা হারিয়ে যাচ্ছেশাপলা,শালুক।কলমি,হেলেঞ্চা,ঢোলকলমি ইত্যাদি আগের মতো পাওয়া যায় না।
প্রথম আলো পত্রিকার মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি আকমল হোসেন নিপু বলেন, মূলত হাওর ভরাটের কারনে জলজ উদ্ভিদ মাছ বা প্রাণীয় আবাসস্থল এবং জলজ কীটপতঙ্গউজাড় হচ্ছে।একসময় হাওর এলাকায় অনেক কচ্ছপ পাওয়া যেত,কিন্তু কচ্ছপের এখন দেখাই মিলে না।হাওরের খালবিল খনন করতে হবে তাতে জলজ উদ্ভিদের সৃষ্টি হবে।জলজ উদ্ভিদ,হিজল,করচ,তমাল রোপন করতে হবে তাতে যেমন হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে তেমনি সৌন্দর্য্য বর্ধন হবে এবং পাখি ও মাছের আবাসস্থলের সৃষ্টি হবে। তাছাড়া কৃষকরা চাষাবাদের ক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈব সার ব্যবহার করা উচিত,সাথে সাথে পাখি শিকার বন্ধ করতে হবে।হাওরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষন করা গেলে হয়তো পূর্বের রূপে ফিরে আসবে না কিন্তু ভারসাম্য ধরে রাখতে সাহায্য করবে।হাওর এলাকায় একটির সাথে আরেকটির সম্পর্ক জড়িত। একটি ধ্বংস হলে আরেকটি ধ্বংস হবে। হাওরের জীববৈচিত্র্য,প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।তার জন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
জীবনযাত্রার দিক থেকে অন্যান্য অঞ্চল থেকে হাওর অঞ্চলের জীবনযাত্রা ভিন্ন প্রকৃতির,তাদেরদৈনন্দিন জীবন হাওর প্রভাবিত ।এখানকার কৃষি ব্যবস্থা,জীবন ও জীবিকা এবং এখানকার সংস্কৃতি ও অর্থনীতিও ভিন্ন।সে জন্য অন্যান্য এলাকার সাথে রয়েছে বৈশাদৃশ্য। হাওর এলাকায় স্বাস্থ্য সম্মত পয়:নিষ্কাশন অন্যান্য এলাকার চেয়ে নাজুক। এ কারণে দূষিত হচ্ছে হাওরের পানি সাথে সাথে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ। হাওরে ঘনবসতি হওয়ার কারনে জলাশয় এবং বিল ভরাট করে ভৌত কাঠামো তৈরী হচ্ছে। এর কারনে যেমন কমছে জলজ সম্পদ তেমনি কমছে জলজ প্রকৃতির সাহচর্যে থাকা জীব বৈচিত্র্য।
মৌসুমের সাথে পাল্লা দিয়ে হাওরপাড়ের মানুষের জীবন বদলায়। যেহেতু মাছ হাওর অঞ্চলের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎস সেহেতু মাছ চাষকে আমাদের বহুমুখীকরন করতে হবে। মাছের প্রাকৃতিক বিচরনের পথগুলো চালু রাখতে হবে এবং তা কোনো অবস্থাতেই যেন বাঁধার সম্মুখীন না হয়।
পরিবেশ আমাদের,সেটা রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু প্রতিনিয়ত আমাদের ভুলের কারনে হচ্ছে পরিবেশের ক্ষতি।হাওরের উন্নয়নে কর্মসূচী গ্রহন করলে একদিকে যেমন হাওড়বাসী উপকৃত হবে, তেমনি দেশ ও অর্থনীতিতে এগিয়ে যাবে। হাওর এলাকাকে পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারলে বদলে যাবে হাওরের জীবন ও বৈচিত্র। উজান থেকে নেমে আসা পানি যাতে নদী ও হাওড় ধারন করতে পারে সে জন্য নদী ও বিল খনন করতে হবে। এতে জলজ উদ্ভিদের সৃষ্টি হবে। জলজ কীটপতঙ্গ বাড়বে। নদী ও বিলের সৌন্দর্য্য বাড়বে।সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হাওড় পাড়ের মানুষের জীবিকা রক্ষার পাশাপাশি হাওরেরজীব বৈচিত্র্য এবং পর্যটন শিল্প বিকাশের পথকে সুগম করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *