বিশেষ প্রতিনিধি : একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায় গত ৫ বছরে সৌদি আরবে গেছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৭৪ জন বাংলাদেশি নারীকর্মী। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত সুখের পরিবর্তে তাদের অনেকের ভাগ্যে জুটেছে শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন-নির্যাতন। কারও কারও সুখের স্বপ্ন পরিণত হয় মৃত্যুতে।
প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে ১৯৮ নারীকর্মী লাশ হয়ে দেশে ফিরেছে। অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে শূন্যহাতে কতজন নারীকর্মী সৌদি থেকে দেশে ফিরেছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বেসরকারি হিসাবমতে, গত ৫ বছরে সৌদি থেকে কম-বেশি ২৪ হাজার নারীকর্মী দেশে ফিরেছে (যাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের সময় গত বছর ফিরেছে ২১ হাজার ৫০০ জন)।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে খালি হাতে প্রচুর নারীকর্মী দেশে ফেরে। নির্যাতনের মাত্রা এত বেশি যে অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, গত পাঁচ বছরে সৌদি আরবে মারা গেছে দুশজন নারীকর্মী। তাদের বেশিরভাগেরই মৃত্যু সনদে উল্লেখ আছে আত্মহত্যা। তিনি আরও বলেন, গৃহকর্মীদের অধিকাংশই অভিযোগ করেছে, সেখানে তাদের নিয়োগকর্তা এবং মক্তবের (সৌদিতে অবস্থিত নিয়োগ প্রতিষ্ঠান) লোকজন বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করে। ফেরত আসা নারীরা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনসহ ঠিকমতো খাবার না পাওয়া, চুক্তি অনুযায়ী নিয়মিত বেতন না পাওয়া এবং নির্ধারিত সময়ের বেশি কাজে নিয়োজিত থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগ করেছে। সেখানে প্রতিনিয়তই নারীকর্মীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
জেদ্দায় সেফহোমে ২১ জন
সৌদি আরবের জেদ্দায় অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন জানিয়েছে, তাদের সেফহোমে গত ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ২১ জন নারীকর্মী ছিল। সেখানকার শ্রম কাউন্সিল এই প্রতিবেদককে জানান, এই নারীকর্মীরা আইনগত সেবা নেওয়ার জন্য মিশনের সেফহোমে আশ্রয় নিয়েছে। মূলত তাদের দুবছরের কাজের মেয়াদ শেষের আগেই তারা দেশে ফিরতে চায়, তাই সেফহোমে এসে আইনি আশ্রয় চেয়েছে।
কেন তারা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে দেশে ফিরতে চায় জানতে চাইলে শ্রম কাউন্সিলর জানান, তাদের ব্যক্তিগত কারণে তারা দেশে ফিরতে চায়। অনেকেই সৌদির আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না, কেউ দেশে বাচ্চা রেখে এসেছে, কারও পরিবারের প্রতি মন টানছে। তাই তারা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দেশে ফিরতে চায়।
ফেরত আসা নারীকর্মীদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২১২ জন নারীকর্মী সৌদি গেছে। কিন্তু কতজন ফিরেছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও দূতাবাসের বরাতে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি জানিয়েছে, ২০১৬-১৯ সাল পর্যন্ত চার বছরে সৌদি আরব থেকে ১৩ হাজারেরও বেশি নারী দেশে ফিরে ফেরে। আর করোনাকালে ফিরেছে ২১ হাজার ৫০০ জন।
বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম এনডিসি এই প্রতিবেদককে বলেন, সৌদি থেকে কতজন নারীকর্মী দেশে ফিরেছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি সেটা বাস্তবায়িত হলে ফেরত আসা কর্মীদের সংখ্যা জানা যাবে।
তিনি আরও বলেন, কর্মীরা দেশে ফেরত আসার পর বিমানবন্দরে একটি ফরম পূরণ করার কথা। কিন্তু দেশে ফেরার পর যে যার মতো নিজেদের গন্তব্যে ফিরে যায়, তারা ওই ফরম পূরণ করে না। তাই ফেরত আসাদের তথ্য সংরক্ষণ করা যায় না।
সৌদিতে নারীকর্মী যাওয়ার পেছনের গল্প
বিএমইটিতে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২১২ জন নারীকর্মী সৌদি গেছে। বিএমইটির এই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে বিপুলসংখ্যক নারীকর্মীর সৌদি যাওয়া শুরু হয়। এর আগে ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সৌদিতে মাত্র ৩২ হাজার ১৩৭ জন নারীকর্মী যায়। ২০১৫ সালে যায় ২০ হাজার ৯৫২, ২০১৬ সালে ৬৮ হাজার ২৮৬, ২০১৭ সালে ৮৩ হাজার ৩৫৪, ২০১৮ সালে ৭৩ হাজার ৭১৩, ২০১৯ সালে ৬২ হাজার ৫৭৮, ২০২০ সালে ১২ হাজার ৭৩৫ এবং চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৪৫৭ জন সৌদি আরবে যায়।
একাধিক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, ২০১৫ সালের এপ্রিলে সৌদি সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশ সেখানে নারীকর্মী পাঠাতে দেশটির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। এমন সময়ে এই স্মারক সই হয়, যখন সৌদিতে বিদেশি নারীকর্মীদের ওপর নির্যাতন-অত্যাচারের অভিযোগে ফিলিপাইনসহ একাধিক দেশ সেখানে নারীকর্মী পাঠানো বন্ধ করে। আর বাংলাদেশ সেখানে নারীদের পাঠাতে সম্মতি দেয়। কারণ তখন দেশের বৃহত্তর স্বার্থরক্ষায় এর বিকল্প ছিল না। কেননা ওই সময়ে বাংলাদেশের ওপর সৌদির চাপ ছিল। বাংলাদেশ যদি নারীদের সেখানে পাঠাতে রাজি না হতো তবে কয়েক লাখ পুরুষ কর্মীকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার হুমকি ছিল সৌদি সরকারের। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক ইস্যুতেও সহযোগিতা না করার হুমকি ছিল। এ কারণে ওই সময় সরকার বাধ্য হয়েই সৌদিতে নারীকর্মীদের পাঠাতে সম্মতি দেয়।
আইন কী বলে
দেশ থেকে যেসব কর্মী বিদেশে কাজ করতে যায় তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত বা বিপদে পড়লে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য শক্ত আইন নেই বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তবে ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন এবং ২০১২ সালের (২০১৭ সালে সংশোধিত) মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা দেওয়া আছে। কিন্তু এসব আইনের বাস্তব প্রয়োগ নেই।
বাংলাদেশ নারীশ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, সৌদিতে যাওয়া নারীকর্মীদের সুরক্ষায় দেশে আইন আছে। কিন্তু সৌদিতে নারীকর্মী পাঠানো হয় সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে, দেশটির সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই। ফলে সৌদি আইনে নারীকর্মীরা নির্যাতনের বিচার চাইতে পারে না। আবার দেশে যে আইন আছে তার প্রকৃত বাস্তবায়ন নেই। ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইনের ৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত নারীকর্মীরা ক্ষতিপূরণের জন্য বিচার চাইতে পারে। কিন্তু সৌদিতে নির্যাতনের শিকার হয়ে যেসব নারী দেশে ফিরে আসে তাদের পক্ষে কোর্টে যাওয়া সম্ভব হয় না। এজন্য সরকারি খরচে তাদের সহায়তা দিতে লিগ্যাল ক্লিনিক স্থাপন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
ভুক্তভোগীদের কথা
অত্যাচার এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি থেকে ফেরত একাধিক নারীকর্মীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে ঢাকার ডালিয়া আক্তার নামে একজন জানান, তার পৌনে ৬ বছর বয়সের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। ছোট এই ছেলেকে দেশে রেখেই সৌদি গিয়েছিলেন ভাগ্য পরিবর্তন করতে, একটু সুখে থাকার আশায়। কিন্তু ফিরেছেন অমানুষিক অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়ে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে এখনও ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। দেশে আসার পর তার সংসার ভেঙে যায়। হারাতে হয়েছে ছেলেকেও।
নরসিংদীর সুখতারা জানান, সৌদিতে তাকে এমন অত্যাচার করা হয়, তিনি যে বেঁচে থাকবেন সেটা একসময় বিশ্বাসই করতে পারতেন না। ভাগ্যক্রমে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সহায়তায় তিনি মৃত্যুপুরী থেকে ফেরেন। কিন্তু এখনও সেই ভয়াবহ স্মৃতি তাকে আতঙ্কিত করে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মী আল আমিন নয়ন এই প্রতিবেদককে বলেন, সৌদিতে নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক নারীকর্মী ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফিরেছে। গত অক্টোবরেও এমন একজন দেশে ফেরে। তাকে মানবিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।-নতুন সময়