মাহফুজ শাকিল : ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা কতিপয় লোকজন একটি মাইক্রোবাস ভাড়া নিল। চালকের সঙ্গে ওই গাড়িতে মালিকও গেলেন। এরপর নিখোঁজ হন গাড়িসহ দুজনই। থানায় মামলার পর তদন্ত এখান থেকে ওখানে গড়ায়। এভাবে এক এক করে কেটে গেছে ২৬টি বছর। কিন্তু কোন কূলকিনারা হয়নি। নিখোঁজ হান্নানসহ তাঁর সহযোগী আজও ঘরে ফেরেননি।
এ ঘটনা মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার। নিখোঁজ দুইজন হলেন কুলাউড়া পৌর শহরের উছলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা গাড়ির মালিক আব্দুল হান্নান ও গাড়ি চালক পাশ^বর্তী জুড়ী উপজেলার বাসিন্দা গিয়াস মিয়া।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫ সাল। বছর ঘুরে এ দিনটি আসলে কুলাউড়ার ওই পরিবারের কাছে পিতা হারানোর স্মৃতি অকপটে ভেসে ওঠে। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও পূর্ব আকাশে বিজয় দিবসের রক্তিম সূর্য উদয় হয়েছিল। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও বিজয় দিবসের বাতাস হু হু হয়ে বইছিল। আর এই বাতাসের মধ্যে কি যেন এক হাহাকার ভরা বেদনা ছিল কুলাউড়াবাসীর জন্য তাইবা কে জানত? কুলাউড়ার ডাকবাংলো মাঠে বিজয় মেলা-৯৫ এর সমাপনী অনুষ্ঠান চলছিল। কুলাউড়াবাসীর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচত ৭ জন যুবক মেলায় অনেকক্ষণ ঘুরাফেরা করে মেলা থেকে বেরিয়েই প্রায় ৩০০ গজ উত্তরে গিয়ে রাস্তায় একটি লাইটেস দাড়ানো দেখে ড্রাইভারকে তারা জানায় যে, তারা ঢাকার বাসিন্দা। মাধবকুন্ড জলপ্রপাত দেখতে এসেছিলেন। তারা ঢাকায় ফেরত যেতে চায়। লাইটেসের ড্রাইভার তাদেরকে ৩৫০০ টাকা ভাড়া দাবী করে। ড্রাইভার গিয়াস যখন যুবকের সাথে আলাপ করে তখন গাড়ীর মালিক আব্দুল হান্নান তখন সেখানে উপস্থিত হয়। আব্দুল হান্নান অবশেষে ঢাকার মালিবাগে যুবকদের নিয়ে যেতে রাজি হন। ১২০০ টাকা অগ্রীম এবং বাকী টাকা ঢাকা যাবার পর দেবার সিদ্ধান্ত হয়। তখন সন্ধ্যা ৭টা বাজে। লাইটেস নং (ঢাকা মেট্রো-চ-০২-৪৫৭৭) ড্রাইভার গিয়াস যাত্রীবেশী কথিত যুবক ও গাড়ীর মালিক আব্দুল হান্নানকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। ঢাকায় যাবার পর সেই থেকে আজ অবধি পর্যন্ত গাড়ির মালিক আব্দুল হান্নান ও চালক গিয়াস নিখোঁজ। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৯৫ থেকে ২০২১ সাল। কেটে গেলো ২৬টি বছর। কিন্তু পরিবার-পরিজন এখনও আশায় বুক বেধে আছেন, তারা ফিরবেন।
আব্দুল হান্নান কুলাউড়া পৌরশহরের উছলাপাড়া নিবাসী মরহুম আব্দুস ছত্তারের ১ম পুত্র। নিখোঁজ আব্দুল হান্নানের ছোট ভাই স্পেন প্রবাসী সাংবাদিক তুতিউর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, আব্দুল হান্নান ও চালক গিয়াস গাড়ীসহ অপরহণ করা হয়েছে বলে ঘটনার দু’দিন পর অনুমান করা হয়। তারা ফিরে না আসাতে তার পরিবারের পক্ষ থেকে কুলাউড়া থানায় জিডি করা হয়। জিডি নং-৬৫১ তাং-১৮.১২.১৯৯৫ এবং পরে এজাহার (নং-১৫ তাং-২৫/১২/১৯৯৫) দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে ডিবি মৌলভীবাজারে স্থানান্তরিত হয়। ১৫ এপ্রিল ৯৬ ইং ডিবি থেকে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি নিখোঁজ দুই ব্যক্তিসহ ছিনতাইকৃত গাড়িটি উদ্বার করা সম্ভব হয়নি।
হান্নান নিখোঁজের ৭ মাস পর স্ত্রী শেফালীর গর্ভে জন্ম নেয় পুত্র পায়েল। আব্দুল হান্নানের ৩ পুত্রের মধ্যে মাহবুব আলম রুবেল বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে এখন চাকুরীর জন্য ঘুরছে। শফিউল আলম সৌরভ মাস্টার্সে অধ্যয়নরত ও শাহরিয়ার আলম পায়েল কোরআনে হাফিজি শেষ করে আলিম ডিগ্রি অর্জন করেছে। তারা তিন ভাই এখন চাকুরীর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। কিন্তু কোন উপায় পাচ্ছেনা। এখন তাদের আগামী ভবিষ্যৎ কি হবে এমন সংশয় তাদের পরিবারের মাঝে। নিখোঁজ হান্নানের পুত্র সৌরভের মনে আজও প্রশ্ন জাগে বাবা ফিরবে তো, বাবাকে স্বচক্ষে দেখতে পারবে তো? সদা হাসোজ্জল হান্নান দীর্ঘ ২৬ বছর থেকে নিখোঁজ। মরে গেছে না বেঁচে আছে কেউ জানেনা। কুলাউড়ার জনগণের মধ্যে সেই থেকে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। জলজ্যান্ত দুটি মানুষ গাড়ী সহ উধাও হয়ে গেল। অথচ জনগণ কি প্রশাসন আজও তাদের কোন সন্ধান দিতে পারলনা।
কুলাউড়া পৌর এলাকার উছলাপাড়ায় গেলে আব্দুল হান্নানের স্ত্রী রহিমা আক্তার শেফালি অশ্রুশিক্ত নয়নে পথপানে আজও তাকান স্বামী ফিরবেন এ আশায়। হান্নানের ভাই বোন ও সন্তানেরা আজও অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। তারা হান্নানের সন্ধান চান। জানতে চান তাদের হান্নান বেঁচে আছে নাকি আদৌ পৃথিবী থেকে চলে গেছে। পুত্র শফিউল আলম সৌরভ অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, আমরা আর কতকাল এভাবে পথ চেয়ে থাকবো। যে সময়টি বাবার বুকে থাকার কথা ছিলো তখন বাবাকে খোঁজ করে হতাশায় দিন কেটেছে। বাবাহীন প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে। বাবার শাসন, স্নেহ ভালোবাসা ছাড়াই জীবনের অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেলো। নিখোঁজের পর মামলাও করা হয়। চাচারাও অনেক চেষ্টা করেছেন বাবার খোঁজ পেতে। মামলা শুধু প্রশাসনের একটি শাখা থেকে অন্য শাখায় স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু আজও বাবার নিখোঁজের বিষয়টি রহস্যবৃত রয়েই গেলো। আমরা আর কতকাল এভাবে পথ চেয়ে থাকবো।
ওদিকে জুড়ী উপজেলায় খোঁজ করেও চালক গিয়াসের কোন স্বজনকে পাওয়া যায়নি। এলাকাবাসী জানান, একসময় গিয়াসের পরিবার মনতৈল এলাকায় থাকতো। বেশ কয়েক বছর আগে পরিবারের সদস্যরা অন্যত্র চলে গেছেন কোথায় সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য কেউ দিতে পারেনি।
মৌলভীবাজার ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু এটা অনেক আগের ঘটনা। তাই এ সম্পর্কে কোন তথ্য আমার জানা নেই। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে হবে।
সিআইডি মৌলভীবাজার কার্যালয়ের সাব ইন্সপেক্টর বিকাশ চন্দ্র দাস বলেন, এতোদিন সিআইডিতে মামলা থাকার কথা না। তৎকালীন সময় হয়তো দায়িত্বে থাকা তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছেন। এখন মামলার সর্বশেষ অবস্থা আদালতে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।