কুলাউড়ায় বেদে পল্লীতে কম্বল নিয়ে ইউএনও ফরহাদ

কুলাউড়া প্রতিনিধি : প্রতিবছরের মত এবারও শীতের প্রকোপ অনেকটা বেড়েছে। আর তীব্র এই শীতে সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকের চেয়ে বেদে সম্প্রদায়ের লোকগুলো সবচেয়ে বেশি অসহায় থাকে। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে শীতে কুপোকাত হয়ে শীতকালীন ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে ভোগেন তারা। যেখানে দু’বেলা দুমুঠো খাবার যোগাড় করতে সারাদিন হন্য হয়ে ঘুরতে হয় তাদের সেখানে শীতবস্ত্র যেন আকাশ থেকে চাঁদ নিয়ে আসার মত গল্পের মত।
কনকনে শীতের রাত। তারমধ্যে চারিদিকে ঘন কুয়াশা। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১১টা পেরিয়েছে। তীব্র শীতের কুয়াশায় সবাই নাস্তানাবুদ। সারাদিনের কাজের ক্লান্তির পর পলিথিন দিয়ে মোড়ানো ঘরে কোনো মতে ঘুমিয়ে পড়েছেন বেদে সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো। বাস্তব জীবনে বেদে লোকজনের খোঁজ সমাজের কয়জনই বা রাখেন? তেমনি মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কয়েকটি বেদে সম্প্রদায়ের লোকগুলোর খবর রাখেনা কেউ। অভিযোগ উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার, চৌধুরীবাজার, লস্করপুরে অবস্থিত বেদে পল্লীর লোকগুলোর। কিন্তুু এবার তাদের খোঁজ রেখেছেন কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী। কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই শুক্রবার রাতে উপজেলার বিভিন্ন বেদে পল্লীতে তাদের কষ্ট স্বচক্ষে দেখতে বের হন ইউএনও এটিএম ফরহাদ চৌধুরী। প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাদের নেই ন্যুনতম শীতবস্ত্র। বেদে পল্লীতে তখন ঘুমের নিস্তব্ধতা। এমন সময় হঠাৎ বেদে পল্লীর দরজায় কড়া নাড়িয়ে একজন বললেন ইউএনও স্যার আপনাদের জন্য কম্বল নিয়ে এসেছেন। এসময় ইউএনও ফরহাদ চৌধুরী উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার, চৌধুরীবাজার, লস্করপুরে অসহায়, দুঃস্থ, শীতার্ত বেদে পরিবারে কম্বল বিতরণ করেন। এসময় ইউএনও’র সঙ্গে ছিলেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ শিমুল আলী, মৌলভীবাজার জেলা সাংবাদিক ফোরামের সহ-সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক এম. মছব্বির আলী।
কথা হয় বেদে সম্প্রদায়ের মহিলা মেঘবালা বেগম (৩০), রুকশানা বেগম (৩৫), রুমি আক্তার (২৫), জুবেদা বেগম (৪৫) ও মেহেরুন নেছা (২০) এর সাথে। তাদের সকলের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলায়। তারা প্রত্যেকেই জানালেন, ‘হঠাৎ করে দরজার সামনে এসে লোকজন ডাকছে। দরজা খুলে দেখি ইউএনও স্যার আমাদের জন্য কম্বল নিয়ে এসেছেন। এর আগে আর কেউ আমাদের কোন খোঁজ রাখেনি, উনি আমাগো দুঃখ-কষ্টের কথা চিন্তা করি কম্বল নিয়া আইছন। এখন শীতর জ্বালায় আমরা আর মরমু না। এর আগেও ইউএনও স্যার করোনাকালীন সময়ে আমাদের পল্লীতে এসে আমাদের খাদ্য সহায়তা করেছেন। এরজন্য আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইউএনও স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। বেদে মহিলারা আরো বলেন, সিঙ্গা লাগানো, দাঁতের পোঁকা ফেলানো এসব করে জীবিকা তারা নির্বাহ করে থাকেন। আর কিছু মহিলা মেয়েদের চুড়ি, ফিতা বিক্রি করে থাকে। আর বেদে পুরুষরা সাপের খেলা দেখায়, পানি থেকে সোনা রুপা তুলে এবং কড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার রাতে উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার, চৌধুরীবাজার, লস্করপুর বেদে পল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন ইউএনও। রাত ১০টায় পৌঁছান ব্রাহ্মণবাজার বেদে পল্লীতে। বেদে পরিবারের লোকজন তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। এমন সময় স্থানীয় মুসলিম এইড হাসপাতালের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত বেদে পল্লীর বাজন মিয়া (৫৮) এর ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেন ইউএনও। ঘুম ঘুম চোখে ঘরের দরজা খুললেন বাজন মিয়া। যিনি স্ত্রীসহ ৬ মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে একটি কুঁড়েঘরে কষ্ট করে থাকেন। তখন পরম মমতায় কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে বাজন মিয়ার পরিবারে ২টি কম্বল দেন ইউএনও এটিএম ফরহাদ চৌধুরী। বাজন মিয়া ছাড়াও এই বেদে পল্লীর জুবেদা বেগম (৪৫), মেহেরুন নেছা (১৭) মত আরো অনেক পরিবারের মধ্যে কম্বল দেয়া হয়। এছাড়া ব্রাহ্মণবাজার-শমসেরনগর সড়কের পাশে অবস্থিত ১২টি বেদে পরিবারে দুটি করে কম্বল দেন তিনি। এসময় ইউএনও বেদে সম্প্রদায়ের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথাও বলেন। বেদে পল্লী থেকে কম্বল বিতরণ শেষে কুলাউড়া ফেরার পথে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সড়কে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কুলাউড়া পৌর শহরের বাদে মনসুর এলাকায় একটি কলোনীতে থাকা ছিন্নমূল ৪০জন মানুষদেরকেও কম্বল বিতরণ করেন তিনি। এছাড়া চৌধুরীবাজার বেদে পল্লীতে ৩৫টি ও লস্করপুরে ১০টি কম্বল দেয়া হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চৌধুরী এই প্রতিবেদককে জানালেন, কুলাউড়া উপজেলায় প্রচণ্ড শীত পড়েছে। উপজেলার কয়েকটি বেদে পল্লীতে তাদের শীতের কষ্ট স্বচক্ষে দেখার জন্য কম্বল নিয়ে যাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিল থেকে উপহার হিসেবে উপজেলায় বরাদ্দ পাওয়া কম্বলগুলো প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরপরও বাদ পড়া ছিন্নমূল মানুষদের খোঁজে খোঁজে সরাসরি কম্বল হাতে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। এর আগে করোনাকালীন সময়ে বেদে পল্লীগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে খাদ্য সহায়তা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল মানুষদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *