বিশেষ প্রতিনিধি : এক বছরেরও বেশী সময় আগে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলেও অদ্যাবধি হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ফলে এ নিয়ে উপজেলা আওয়ামীলীগের দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। দলে উপ-দলে বিভক্তির সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ, দীর্ঘ ১৬ বছর পর ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর দক্ষিণ সুরমার কুচাই ইছরাব আলী হাই স্কুল ও কলেজ মাঠে ঝাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট আলহাজ্ব মোঃ লুৎফুর রহমান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন এবং প্রধান বক্তা জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও সাবেক সিটি মেয়র সদ্যপ্রয়াত আলহাজ্ব বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। তবে অনেকে মনে করছেন সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের পদাংঙ্কঅনুসরণে ব্যস্ত রয়েছেন উপজেলা আওয়ামীলীগের নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। দলীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানাদি নিয়েই তাদের সময় কাটছে। ফলে, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও উপজেলা আওয়ামীলীগের পূণার্ঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি নেতৃবৃন্দ। তারা মনে করছেন জেলা মহানগর কমিটি হওয়ার পর তাদের পছন্দের লোক নিয়ে কমিটি গঠন করবেন। ক্ষমতাসীন সরকারের অংশিদার হয়েও কমিটি গঠন করতে না পারাকে তাদের দলীয় ব্যর্থতা বলে অনেকে ধারণা করছেন। সম্মেলনে মোট ৩৬৯ জন ভোটার ছিলেন। এরমধ্যে ৩৬৪ জন কাউন্সিলর গোপন ব্যালটের মাধ্যমে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করেন। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সরাসরি তত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সন্ধ্যে ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে। নির্বাচনে সভাপতি পদে মোট ৬ জন প্রার্থীর মধ্যে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মোঃ সাইফুল আলম ১৫৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর প্রতিদ্বন্ধী শাহ ছমির উদ্দিন ৯৩, আব্দুর রব ৫৭, তপন চন্দ্র পাল ২৭, সিলাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সৈয়দ মকবুল হোসেন মাখন ২১ এবং শাহেদ হোসেন ৯ ভোট পান। অপরদিকে সাধারণ সম্পাদকের ৪ জন প্রার্থীর মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত ডা. মোঃ আব্দুস শুকুরের ছেলে, তরুণ আইনজীবী এ্যাডভোকেট শামীম আহমদ ১০৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর প্রতিদ্বন্ধী বদরুল ইসলাম পান ১০১, রাজ্জাক হোসেন ৮৮ এবং মোগলাবাজার ইউপি চেয়ারম্যান, সাবেক ছাত্রনেতা ফখরুল ইসলাম শায়েস্তার প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬৪। জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত উপজেলা সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর অদ্যাবধি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মোঃ সাইফুল আলম বলেন, ‘আমাদের উপজেলা সম্মেলনের পর পরই জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন শেষ হয়। আর জেলা সম্মেলন শেষ হতে না হতেই কেন্দ্রীয় সম্মেলনের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে তা সম্পন্ন হয়। এরফলে জেলা নেতৃবৃন্দ ব্যস্ত থাকায় পূর্ণাঙ্গ উপজেলা কমিটি গঠন প্রক্রিয়া শুরুতেই হোঁচট খায়। এরমধ্যেই বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদূর্ভাব দেখা দেয়। দেশব্যাপী সৃষ্টি হয় নতুন আতঙ্কের। দেশবাসীকে নিরাপদ রাখার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। ফলে সারাদেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম অনেকটা স্থবির বা অফিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ সব কারণে উপজেলার পুর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন বিলম্বিত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের পর পরই জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঠিক আমাদের মতো সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেন্দ্র সিলেট জেলা বা মহানগরের পুর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে পারেনি।’ বিলম্বের কারণ কী? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশের প্রথম সারির একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। এখানে নেতৃত্ব নির্বাচন বিরাট একটি চ্যালেঞ্জ। তার উপর দীর্ঘ সময় থেকে দল ক্ষমতাসীন। টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় থাকায় নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতৃত্বকে কঠোর হিসেব-নিকেশ করে যোগ্য ব্যক্তিদের হাতেই দলের দায়িত্ব দিতে আগ্রহী। এজন্য প্রচুর যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন হচ্ছে। এসব কারণে পুর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। তবে আপনাদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই, আমাদের দিক থেকে কোন ঘাটতি নেই। আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন। পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি ঘোষণা হয়ে গেলেই আমাদের উপজেলা কমিটি ঘোষণা হতে খুব বেশী বিলম্ব হবে না।’ তিনি বলেন, ‘শুধু আমাদের উপজেলা শাখাই নয়, একই কারণে আরো অনেকগুলো উপজেলা শাখারও কমিটি ঘোষণা সম্ভব হচ্ছে না।’ সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট শামীম আহমদ বলেন, ‘আমাদের উপজেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। তবে কেন্দ্র থেকে জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত উপজেলা কমিটি জমা দেয়ার সুযোগ নেই। কারণ এখানে অনুমোদনের একটি সাংগঠনিক বিষয় তো রয়েছেই। এরপরও আমরা উপজেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাংগঠনিক বিধি অনুযায়ী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি।’ তিনি বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা না হওয়ায় সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় আমাদেরও কিছু ব্যাঘাত ঘটছে। তাই আমরাও প্রত্যাশায় রয়েছি, যাতে দ্রæততম সময়ের মধ্যে আমাদের উপজেলা কমিটি ঘোষণা করা হয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পূর্বে আমাদের ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টি ইউনিয়ন শাখার মেয়াদ বিদ্যমান রয়েছে। শুধুমাত্র বরইকান্দি ও মোগলবাজার ইউনিয়নের মেয়াদ ইতোমধ্যেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আমাদের কমিটি অনুমোদিত হয়ে গেলেই আমরা মেয়াদ উত্তীর্ণ শাখা কমিটিগুলোর ব্যাপারে দ্রæত সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেবো। সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সদস্য, সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মঈনুল ইসলাম বলেন, করোনা এবং সমসাময়িক অসুবিধার কারনে উপজেলা আওয়ামীলীগের কমিটি গঠন করা সম্ভব না হলেও দলীয় কর্মকান্ডে সকলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তবে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কমিটি গঠন না করা অবশ্যই দলীয় ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এজন্য নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দ্রæততম সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা উচিত। উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ্ব মোঃ আব্দুস ছত্তার বলেন, ‘সম্মেলনের পর নেতা-কর্মীদের প্রত্যাশা ছিল খুব স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই হয়তো পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু কার্যতঃ কেন্দ্র ও জেলা নেতৃবৃন্দের ব্যস্ততা এবং করোনা মহামারীর কারণে এখনও পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। আমরা আশা করছি, খুব শিগগির-ই হয়তো পদ-পদবীগুলো পূর্ণ করে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। এতে করে দলের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে এবং সাংগঠনিক কার্যকমে নেতাকর্মীদের স্পৃহা আরো বাড়বে।’