কুলাউড়ায় মুক্তিযুদ্ধে আহত নূরজাহানের মস্তিষ্কের ভেতর মর্টার শেলের টুকরো!

বিশেষ প্রতিনিধি : ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর ছোড়া মর্টার শেলে আহত হন নূরজাহান বেগম (৭০) নামের এক নারী ও তাঁর স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মো. নুরু মিয়া। সে সময় তিনি ও তাঁর স্বামী কাকতালীয়ভাবে বেঁচে যান। কিন্তু নূরজাহানের মস্তিষ্কের ভেতরে রয়ে যায় মর্টার শেলের একটি টুকরো। সেই টুকরো নিয়ে তিনি আজ ৫০ বছর ধরে এখনো বেঁচে আছেন। বর্তমানে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার থাকার কারণে নূরজাহানের স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে শুরু করেছে। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, মস্তিষ্কে মর্টার শেলের একটি টুকরো রয়ে যাওয়ায় সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এতে তাঁর এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাঁকে ভালো চিকিৎসা করাতে সহযোগিতা চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন কুলাউড়ার বাসিন্দা ও সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মনো ও স্নায়ুরোগ চিকিৎসক (সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি বিভাগ ) ডা. সাঈদ এনাম। (বৃহস্পতিবার) বিকেলে কুলাউড়ার টিলাগাঁওয়ের লংলা খাস এলাকায় ওই নারীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নূরজাহান বসতঘরের বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে আছেন। এসময় পরিবারের স্বজনদের দিকে তিনি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। তবে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন না। নূরজাহানের মূল বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার আমোদাবাদ এলাকায়। বর্তমানে তাঁদের পরিবার কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের লংলা খাসের নতুন বস্তি এলাকায় বসবাস করছেন।
জানা যায়, দেশমাতৃকার টানে নূরজাহানের স্বামী নুরু মিয়া যুদ্ধে চলে যান। বাড়িতে ছিলেন স্ত্রী নূরজাহান বেগমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। একপর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্তঘেষা আমোদাবাদ এলাকায় হামলা চালায়। এসময় মর্টার শেলের আঘাতে নূরজাহানের পিতা আনছার আলী, ছোট ভাই নূর ইসলাম (১২), বোন জাহেরা খাতুন (১৬)  ঘটনাস্থলেই মারা যান। এছাড়া মর্টার শেলের ছোড়া আঘাতে নূরজাহানসহ তাঁর মাতা ফুলজান বেগম গুরুতর আহত হন। শেলের আঘাতে নূরজাহানের মস্তিষ্ক, বাম হাত ও বাম পায়ের উরুতে আঘাত লাগে। আর তাঁর মাতা ফুলজানের পেটের ভূঁড়ি বের হয়ে যায়। এসময় নূরজাহনের বড় ভাই মো. রশিদ মিয়া (৭৫) মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির বাক্স এগিয়ে দিতে গেলে শেলের আঘাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান।
নূরজাহানের স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মো. নুরু মিয়া ২০১৯ সালের ২ জুন বার্ধক্যজনিত কারনে মারা যান। তাঁর পরিবারে ২ ছেলে ও ৫ মেয়ে সন্তান রয়েছেন। বড় ছেলে মোবারক হোসেন সৌদি আরব প্রবাসী ও ছোট ছেলে মো. জালাল হোসেন সৌদি আরব প্রবাসী। দুজনই বর্তমানে দেশে ছুটি কাটাতে এসেছেন। ৫ মেয়ে সন্তানদের মধ্যে মমতা বেগম, আমেনা বগেম, আনোয়ারা বেগম, সখিনা বেগমের বিয়ে হয়ে গেছে। দ্বিতীয় মেয়ে আলেয়া বেগম মারা গেছেন।
নূরজাহানের বড় ছেলে সৌদি আরবপ্রবাসী মোবারক হোসেন ও ছোট ছেলে জালাল হোসেন বলেন, যুদ্ধের পর তাদের জন্ম হয়। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁদের মা-বাবার বিয়ে হয়েছিল। তাঁদের বাবা নুরু মিয়া ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের এলাকায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালায়। এ সময় অনেক মানুষ হতাহত হন। তখন আমাদের মাতার শরীরের বিভিন্ন স্থানে মর্টার শেলের আঘাত লাগে। পরে তাঁকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে ৬ মাস তাঁর চিকিৎসা চলে। যুদ্ধ শেষে নুরু মিয়া তাঁকে নিয়ে বাড়িতে ফেরেন। তখন নূরজাহানের চিকিৎসার যাবতীয় কাগজপত্র হারিয়ে যায়। কিন্তুু তিনি আজো মুক্তিযোদ্ধার কোন স্বীকৃতি পাননি।
তারা আরো জানালেন, আখাউড়াতে বাড়ির ভিটা বাদে তাঁদের আর কিছু ছিল না। অভাব-অনটনে পড়ে যুদ্ধের পর তাঁদের বাবা সেই ভিটা বিক্রি করে দেন। ১৯৭৬ সালে তাঁর বাবা কাজের সন্ধানে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে কুলাউড়ায় চলে আসেন। ভূমিহীন হিসেবে উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের লংলা খাস এলাকায় আশ্রয় নেন। ১৯৯৭ সাল থেকে তাঁর বাবা নুরু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানী ভাতা পাওয়া শুরু করেন। জমানো ভাতাসহ আরও কিছু টাকা ধারদেনা করে তাঁদের বিদেশে পাঠান। ২০১৫ সালে মোবারক ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের পশ্চিম গুড়াভুঁইয়ে কিছু জমি কিনে পাকা ঘর তুলেন। মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেখানে ওঠেন। তারা আরো বলেন, আঘাতের কারণে তাঁদের মা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। এখন তাও পারছেন না। এছাড়া এত দিন তাঁর স্মৃতিশক্তি ভালোই ছিল। প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগ থেকেই হঠাৎ স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। এরপর চিকিৎসক সাঈদ এনামের চেম্বারে নিয়ে যান। তাঁর পরামর্শে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করান। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় বাড়িতে নিয়ে আসেন।
নূরজাহানের পরিবারের স্বজনদের এখন দাবি, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পরিবারের তিনজন সদস্য মারা যান। আমাদের বাবার সাথে আমাদের মাতাও যুদ্ধে অংশ নেন। আমাদের মাতা একজন মুক্তিযোদ্ধা। সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে তিনি বঞ্চিত রয়েছেন। এখন আমরা আমাদের মাতার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চাই। এছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে মানবিক আবেদন জানাচ্ছি, তিনি যেন এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে আমাদের মাতার উন্নত চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি বিভাগ) ও আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়শনের ফেলো ডা. মো. সাঈদ এনাম বলেন, আমার চেম্বারে নিয়ে আসার সময় নূরজাহানের কিছুটা স্মৃতিশক্তি ছিল। অসুস্থতার ইতিহাস জানাতে গিয়ে অগোছালোভাবে মুক্তিযুদ্ধকালে আহত হওয়ার বিশদ ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। মাথায় আঘাত পাওয়ার কথাও বলেন। যারপ্রেক্ষিতে ওই নারীর মস্তিষ্ক এক্সরে করে তাঁর মস্তিষ্কের ভিতরে মর্টার শেলের একটি টুকরোর অবস্থান দেখা যায়! এরকম ঘটনা অলৌকিক এবং বিস্ময়কর। গত ৫০ বছরে এই শেলের টুকরো তার মস্তিষ্কের প্রায় এক তৃতীয়াংশ  গলিয়ে ফেলেছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘পরেনসেফালী’ (চড়ৎবহপবঢ়যধষু) । মস্তিষ্কের ভিতর মর্টার শেলের টুকরো নিয়ে ৫০ বছর বেঁচে থাকাটা সারা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্যে বিরল ঘটনা। এবং সাইকোট্রিক প্রেসেন্টেশন নিয়ে উপস্থিত হওয়াটাও চিকিৎসা বিজ্ঞানে অত্যন্ত বিরল। এ পর্যন্ত মাত্র ৫ টি কেইস পাওয়া গিয়েছে জার্নালে।
তিনি আরো বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-বর্তমান মেডিসিন চিকিৎসায় তিনি খানিকটা সুস্থতা বোধ করলেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধা নারীর নিউরোসার্জারি নিউরোসাইকিয়াট্রি বোর্ড সমন্বয়ে আরো ভালো একটি চিকিৎসা প্রয়োজন। এমনও হতে পারে, অপারেশন করে তার মস্তিষ্কের ভেতর থেকে মর্টার শেলের টুকরোটি বের করা এবং মস্তিষ্কের পঁচে যাওয়া অংশ যত দূর সম্ভব বের করা। অস্ত্রোপচার করলে হয়তো এ অবস্থার উন্নতি ঘটতে পারে। তবে এটা ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ বটে। সম্ভব হলে দেশে না হলে বিদেশে নিয়ে এই অপারেশন করা লাগতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *