কুড়ি টাকার কি অদ্ভুত ক্ষমতা

সহস্র সুমন : ভদ্র লোকের নাম মজু মিয়া (কাল্পনিক) । গ্রাম এলাকায় যেভাবে রিক্সা রিসকা হইয়া যায়, বিপ্লব বিপুল হইয়া যায়, লাল নাল হইয়া যায় সেভাবে মজিদের নামটিও মজু হইয়া গিয়াছে। শহরে লকডাউন আসিয়াছে, কিন্তু গ্রামের মানুষ নাকি সে শব্দের সাথে পরিচিত ছিল না কোন কালে।

বেশিরভাগ মানুষের ইহাই বক্তব্য, “এসব লকডাউন কি হামরা বুঝিরে ভাউ? হামরা করা খাবার লাগিছি আর পুলিশ খালি দাবর দেছেরে (ধাওয়া দিচ্ছে)।”

মজু কিন্তু এ কাতারের লোক নহে। মজু জানেন লকডাউনের অর্থ ঘর হইতে বাহির হওয়া যাইবে না। জানেন যে দোকান পাঠ খোলা যাইবে না। তিনি গ্রাম পুলিশের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৮ সালে ক্লাস এইট পাশ দিয়াছেন। চাকরি শেষ হইয়া গেলে কি করিয়া খাইবেন সে চিন্তা ছিল পূর্ব থেকেই। তাই বুদ্ধি করিয়া শিখিয়া নিয়াছিলেন সাইকেল মেরামত, টায়ার শেলাই ও জুতা মেরামত এবং নির্মান কর্ম।

কিন্তু গ্রামে খুব একটা আয় রুজি হয়ও না। এদিকে লকডাউন দেয়ায় অবস্থার আরও অবনতি । তাই লকডাউনের অর্থ জানিবার পরও নিরুপায় হইয়া দোকান খুলিয়াছেন। মজু কাজ করিতে করিতে হঠাৎ সাইরেনের শব্দ শুনিতে পান। তিনি বিচলিত হন না। তিনি জানেন যে, হয় টিএনও আসিতেছে, অথবা এসিল্যান্ড বা ওসি।

এ সাইরেনের শব্দে সাড়া দিয়া ঠাস ঠাস বহু স্যালুট মারিবার অভিজ্ঞতা তাহার আছে। কিন্তু এখন আর শরীর সাড়া দেয় না। সাড়া দেয় না মনও। কারণ গ্রাম পুলিশের কাজ শেষ করিয়াছেন বেশ খানিকটা অভিমান নিয়াই। আরও কিছু সুযোগ সুবিধা তিনি আশা করিয়াছিলেন।

সাইরেনের শব্দ ক্রমেই বাড়িতে লাগিলো। একসময় একেবারে গায়ের কাছে আসিলো। সাদা ধবধবা একটা গাড়ি কষে মারিলো বেরেক। আশেপাশে কয়েকটা দোকান খোলা ছিল তখনো। সেগুলোর ঝাপ সরাত সরাত (তাড়াতাড়ি) নামাইয়া দিয়া দৌঁড়াইয়া পালাইলো দোকানিরা।

কয়েকটা অল্প বয়স্ক আড্ডাবাজ বর্ধিষ্ণু বালক বন্ধ চায়ের দোকানের বেঞ্চে আড্ডা দিতেছিল। তাহারাও দিকবিদিক দৌঁড়াইয়া চলিয়া গেলো নিমেষে। মোটরযান হইতে হালকা পাতলা গড়নের একজন কর্তা বাহির হইলেন। পেছনের বিজিবির শকট হইতে বাহির হইলো অস্ত্রধারী সৈন্যরা।

যুবক কর্তার চৌকস চলন বলন ও বয়সের মেজাজে বলিয়া দেয়া যায় যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটই হইবেন। যে হবার হইবেন, মজু নিজ কর্মে মনযোগ দিলেন। এক দরিদ্র ভ্যানওয়ালা একটা টায়ার সেলাই করিতে দিয়া গিয়াছে। সেটাই করিতেছিলেন মজু। কামাই নাই এ-কদিন।

এই টায়ারটা শেলাই করিয়া দিলে কুড়ি টাকা পাওয়া যাইবে। সাইরেনের শব্দ, সৈন্যদের বুটের আওয়াজ, ম্যাজিস্ট্রেটের তীক্ষ্ণ চাহুনি, লোকেদের দৌঁড়াদৌড়ি কোন কিছুই এই কুড়ি টাকা অপেক্ষা ক্ষমতাবান মনে হইতেছে না মজুর কাছে।

অতএব সেলাই চলিতে থাকিলো। যুবক ম্যাজিস্ট্রেট সাব একে ওকে শ-দুশো (১০০/২০০) টাকা জরিমানা করিতে লাগিলেন। সৈন্যরা উৎসুক জনতাকে বোঝাইলেন করোনা বড় কঠিন অসুখ, দ্রুত ঘরে গিয়া যার যার মত খিড়কি লাগাও। জরিমানা, দৌঁড়াদৌঁড়ি , সাইরেন শেষ হইলে ম্যাজিস্ট্রেটের চোখ এবার পড়িলো মজুর নির্লিপ্ত সেলাইরত বাহুর দিকে।

দুনিয়া থামিয়া গিয়াছে, লোকেরা উঠিয়া গিয়াছে গৃহে, জরিমানার অনাদায় কারাদণ্ড হইবারও উপক্রম হইয়াছিল অনেকের। কিন্তু ইনি কে? শাসন- ত্রাসন, ভূমিকম্প সৃষ্টি করিবার মত মহানাদকারী ফুৎকার ভেদ করিয়া মনোনিবেশ করিয়াছেন সামান্য সূঁচাগ্রে।

হেকিমের কি আত্ম গরীমার কোথাও কমতি ছিল নাকি যে তাহাকে ও তাহার দলবলকে এমনভাবে উপেক্ষা করা যাইতেছে? ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তীক্ষ্ণ চক্ষু দুটিকে আরো সূঁচালো করিয়া দেখার চেষ্টা করিলেন কি এমন মহাবিশ্ব জয় করিবার কারবার খুলিয়াছেন এই প্রৌঢ় যা তাহাকে সকল শাস্তি ও আইন বিধানের ভয় জয় করা শিখাইয়া দিয়াছে। তিনি আসিলেন। বৃদ্ধের দোকানের সামনে কে যেন একটা মোটর সাইকেল রাখিয়াই পলায়ন করিয়াছে। তবু বৃদ্ধ যায় নাই।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আগাইলেন। যতটা নীরব পায় ও শিকারির মত আসিয়াছিলেন প্রথম অভিঘাত ততোটা প্রবল হইলো না। তিনি বরং যতোটা গলা নামাবার যায় ততোটা নামাইয়া জিজ্ঞাসিলেন, “কীগো বাবাজি, এদিকে দুনিয়া কাঁপিতেছে, আসমান নাচিতেছে, লোকেরা লুঙ্গিটুঙ্গি খুলিয়া আতঙ্কে ছুটিতেছে, আর আপনি কিনা এই সূঁচের মায়া ছাড়িতে পারিলেন না!”

 

লেখক, সহস্র সুমন
পৌড় আধুনিক ক্যামেরার স্লো মোশনের চেয়েও ধীরে মাথা তুলিলেন। মাথাখানা উঠিলে সে চরম নির্লিপ্ত মুখখানা দেখিবেন হেকিম সাহেব তাহার জন্য দু চার দণ্ড অপেক্ষা করিতে হইলো। মুখখানা উঠিল। ভীষণ প্রৌঢ়, ভীষণ মায়া। অক্ষিবিভ্রমে দেখিতেছে কিনা বুঝিতে পারা যায় না, কোথায় তাকাইয়াছেন তাও অনুধাবন করা যায় না। তাহার নেত্রে ব্যামো আছে বলিয়াই মনে হয়। তবে সঠিক দিকেই সেলুট মারার মত স্যালাম ঠুকিলেন। তাহার পর বেশ সময় নিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, “স্যালাম স্যার বাবাজি, আমি আপনার আগমন বুঝতে পেরেছি, কিন্তু অত দ্রুত প্রস্থান করার মতো শারীরিক অবস্থা আর নাই।”

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের চোখে মায়া ভর করিলো। ছোট্ট ভাঙ্গা দোকানটার সামনে বৃদ্ধের গা ঘেঁষে একটা মোড়া পাতা ছিল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ওটাতে বসিলেন। উৎসুক চোখে বলিলেন, লকডাউন চলছে বাবাজি। করোনা কাউকে ছাড়ে না। সব বন্ধ রাখা হয়েছে, এই সূঁচের মায়া ছাড়তে হবে তো! বৃদ্ধ হাসিলেন।

এই “হাসিলেন” শব্দের সরলতায় পরিবেন না কেহ। এ হাসি হাসি নয়, এ হাসির গভীরতা বিস্তারিত বলিবো। হাসিয়া কি বলিলেন সেটা বলি। বলিলেন, “সূঁচের মায়া দেখলেন হুজুর! এর পেছনে যে কুড়ি টাকার কি অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তা দেখলেন না? বেয়াদবী নেবেন না জনাব। কাজটা হলে কুড়ি টাকা পাবো, নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যাবো। আর আসবো না আজ, তবে কাল আবার আসবো। যে টাকার জন্য আমি সূঁচ ধরেছি, সে টাকার জন্যই আপনার লোকে অস্ত্র ধরেছে। সবই জীবিকা জনাব।”

ম্যাজিস্ট্রেটের পেছনে দাঁড়ানো অস্ত্রধারীদের অস্ত্র খানিকটা ঢিলে হইয়া গেলো। তাহারা আতঙ্কে পড়িয়া গেলো ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এ কথায় রাগান্বিত না হইয়া যায়। রাগান্বিত হইয়া বৃদ্ধকে দণ্ড দিয়া দিলে তাহা দুঃখজনক হইবে। শত হইলেও একজন নিরুপায় প্রৌঢ় বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু অস্ত্রধারী সৈন্যরা খানিকটা বিস্মিত হইলো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আরো উৎসাহিত হইয়া প্রশ্ন বাড়াইলেন। “ছেলেপুলে নাই? কি করে তারা? আজ কামাই কত হলো? দিনে কেমন আয় হয়? ত্রাণ সহযোগিতা পান? পেলে নেবেন?”

প্রৌঢ় জানাইলো সবই সবিস্তারে। সন্তান বলিতে দুই কন্যা ও এক পুত্র। কন্যারা বিবাহ হইয়া শ্বশুরালয়ে থাকে বটে, তবে কনিষ্ঠ কন্যার ঘরে সুখ নাই। আর পুত্র জমিদার অকর্মন্য। ঘুরিয়া বেড়াইয়া বড় বড় বাণী সরবরাহ করিয়া থাকে। ওটাকে একটু ডান্ডা সম্প্রদান করা যায় বলিয়াও মন্তব্য করিলেন বৃদ্ধ। আয় রোজগার বলিতে দৈনিক শ খানেক টাকা হয়। কিন্তু করোনা আসিবার পরে পঞ্চাশের বেশি নয়। ত্রাণ একবার পরিষদ থেকে পাওয়া গিয়াছিল, কিন্তু বারে বারে অন্যের দ্বারে যাওয়াও লজ্জার। তাছাড়া গ্রাম পুলিশ থাকিতে একটা সম্মান লইয়া চলার পর ত্রাণের পিছে ছুটলে সে সামান্য মর্যাদায় ঘাটতি পরে বৈকি। তাই কর্মই শ্রেয়, উপাদেয় ও শ্রদ্ধেয়।

আহা! কী চমৎকার। কথা শুনিয়া সকলের প্রাণ জুরাইতেছিল। ইতিমধ্যে বদ্যি, কৃষি-কীটনাশক ও সার -বীজের দোকান ব্যাতীত সকলি বন্ধ হইয়াছে, ও কটা লোক ছাড়া সকলে বিদায় হইয়াছে। সার বীজের দোকানিরাও আগ্রহ লইয়া অগ্রসর হইলেন। কথা বার্তা অনেক হইলো। এবার হাকিম সাহেব রায় শোনাইলেন। “দোকান যে বন্ধ করতে হয় বাবা।”

কুড়ি টাকার কি অদ্ভুত ক্ষমতা
“আজ্ঞে, কুড়ি মিনিট সময় নেব। তার পর বিদায় হবো।” বৃদ্ধ তাহার মর্জি জানাইয়া দিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাহার ঠিকানা বিস্তারিত লিখিয়া লইলেন। আবার জিজ্ঞাস করিলেন, যদি আপনার হাতে কটা টাকা দিয়া যাওয়া হয় সরকারের পক্ষে তাহা হইলে তিনি তা লইবেন কিনা? তিনি বলিলেন “কোথাও চাইতে পারবো না বাবা। কেউ দায়িত্ব মনে করে দিলে তা কেন গ্রহণ করব না। সরকারের ত্রাণ তো দান নয়, এও আমাদের হক। তবে হক বন্টনে গোলযোগের ভয়ে কোথাও যাইনে।”

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পকেটে হাত দিলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গণের কাছে তিনি শিখিয়াছেন, মানবিক হও, উপায় না দেখিলে নিজের থলে থেকেই দিও মাঝে মাঝে। তবে গরীব মারিও না, অমানবিক হইয়ো না। গাড়িতেও ত্রাণের বস্তা লইয়াই ঘোরা হয় এখন।

দুঃস্থ দেখিলেই সম্প্রদান। পাঁচশ টাকার একখানা নোট বাহির হইতে দেখিয়া মজু মিয়া আনন্দিত না হইয়া বরং দুশ্চিন্তায় পরিয়া গেলেন। যদি বলে একশত রাখিয়া চারিশত ফেরত দাও তাহলে তাহা আর সম্ভব হইবে না। মজু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে আগ বাড়াইয়া বলিতে চায় যে স্যার বাবাজি, টাকা তো খুচরা নাই। কিন্ত তিনি বলিবার আগেই ম্যাজিস্ট্রেট সাব বলিলেন, এই নিন বাবাজি, তেমন কিছুতো আর আপাতত করতে পারছি না, তবে এটা রাখেন। আর আপনার নাম ধাম নিয়ে গেলাম, উপজেলা নির্বাহী মহোদয়কে জানাবো, এলাকার মেম্বরকেও বলব, আশা করি সমস্যা হবে না। এখন বাড়ি যান।

“মজু মিয়ার চোখটা আনন্দে খানিক স্থবির হইয়া রহিল। তাহার পর টাকাটা লইয়া দুহাতের পাঞ্জার মধ্যে ফেলিয়া ওটা সমেত দুহাতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে ভালোবাসার প্রণামের ভঙ্গি করিলেন। অস্ত্রধারী লোকেদের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি দেখা দিলো। শুধু জরিমানা আর দন্ড দেখিয়া তাহারাও যেন ক্লান্ত। মানবিক কিছুর অংশ হইতে পারাটা আনন্দের। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বড্ড তাড়া। তাই আর বসিলেন না। উঠিলেন। মজু মিয়া এবার বলিলেন, স্যার বাবাজি, টাকার জন্য চলে গেলে তো গেলাম। একটা লোককে কথা দিয়েছি যে আধা ঘণ্টার মধ্যে টায়ারটা ফেরত দেবো। এসে খুঁজবে। আমাকে কুড়ি মিনিট সময় কি দেয়া যায়? নাহলে কথার বরখেলাপ হয়ে যাবে যে বাবাজি। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব গাড়িতে উঠিলেন, অস্ত্রধারী লোকদের পেছনের গাড়িতে ওঠার নির্দেশ দিলেন। গাড়ির জানালার ফাক দিয়া বলিলেন, “মজু মিয়া, কাজ শেষ করে বাড়ি চলে যেয়েন। দিনকাল ভালো না, কথা দিয়েছেন তাকে সে কথা যেহেতু রাখছেন, আমাকেও কিন্তু কথা দিলেন : কুড়ি মিনিট পর দোকান বন্ধ করবেন।”

জ্বি বাবাজি, দিলাম কথা!

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও বলিলেন, “আমরাও কথা দিচ্ছি, আপনারা আমাদের সহযোগিতা করলে এ অ

দেখা শত্রুকে আমরা অবশ্যই হারাবো, জিতবো আমরা। বেঁচে যাবো সবাই একসাথে। কথা দিলাম। ”-নয়া শতাব্দী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *