ফকির আলমগীর-কিছু স্মৃতি কিছু কথা

এম এম শাহীন : কম্পিউটার খুলতেই পর্দায় ভেসে উঠলো একটি দুঃসংবাদ! চলে গেলেন কিংবদন্তি গণসংগীতশিল্পী ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীর। খবরটি চোখে পড়তে প্রথমেই ভড়কে গেলাম।মাত্র ৭১ বছর বয়সে তার এই চলে যাওয়া দেশের জন্য যে কতো বড় ক্ষতি হলো ! তা ভেবে পাচ্ছিনা।

১৯৮৮ সাল। আজ থেকে প্রায় ৩৩ বছর আগের রঙিন সব স্মৃতি মুহূর্তেই মনের পর্দায় ভেসে উঠলো।নিউইয়র্কে তখনো আমার বাস খুব বেশিদিন হয়নি। বয়সেও তরুণ।প্রিয় বাংলাদেশের প্রথিতযশা গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর, চট্টগ্রামের বিখ্যাত আঞ্চলিক গানের শিল্পী দম্পতি শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, চিত্রনায়িকা অঞ্জনা ও নৃত্যশিল্পী মমতাজের আমেরিকার ভিসা হয়েছে। সিলেটের শামীম ট্রাভেলস এর সত্ত্বাধীকারী শামীম আহমেদ তাদের ভিসায় সহযোগিতা করেছিলেন।কিন্তু আমেরিকায় তারা আসবেন কিনা এ বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্ধ্বে আছেন।শামীমের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি অনুষ্ঠান আয়োজনে আমার পরামর্শ ও সহযোগিতা চাইলেন।আমিও তাকে আশ্বস্ত করলাম। পরবর্তীতে তিনি এয়ার টিকিট পাঠিয়ে দিলে কিছুদিন পর যথারীতি তারা নিউইয়র্ক আসেন। লাহিন ভাই (প্রবীণ প্রবাসী বর্তমানে ব্রঙ্ক্স এ বসবাস) বাসায় তারা অবস্থান করছেন।

অতীতে ব্যক্তিগত কোন যোগাযোগ না থাকলেও ফকির আলমগীর ভাই নিমিষেই আমাকে তার আপনজনের মতোই বুকে জড়িয়ে ধরেন।

এই প্রথম আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে জাতীয় পর্যায়ের তারকারা নিয়ে অনুষ্ঠান।আমেরিকায় বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পেয়ে আমি তা কাজে লাগাতে মাঠে নেমে পড়ি। প্রথম প্রোগ্রাম আয়োজন করি নিউইয়র্কে। কুইন্স প্লাজা সংলগ্ন একটি হাইস্কুলের অডিটোরিয়ামে। প্রথম অনুষ্ঠানেই বাজিমাৎ! প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিজ দেশের শিল্পীদের পাশে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ফকির আলমগীর তার দরাজ ও ভরাট কণ্ঠে গণসঙ্গীত গেয়ে অডিয়েন্সকে একরকম আবিষ্ট করে ফেলেন। শেফালী ঘোষ-শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান এবং চিত্রনায়িকা অঞ্জনা ও নৃত্রশিল্পী মমতাজ নৃত্যের ঝংকারে সবাইকে উতলা করে তোলেন।

প্রথম আয়োজনে যে এমন বিশাল সাড়া পাবো তা ছিলো কল্পনার বাইরে।

শিকাগোতে বসবাসরত বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের অন্যতম প্রধান মকবুল ভাই, জামান ভাই(বর্তমানে ফ্লোরিডা) ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ ভাই, মিশিগান থেকে বকুল ভাই, শামীম ভাই এবং লস এঞ্জেলেস থেকে বন্ধু-সংগঠক মমিনুল হক বাচ্চু যোগাযোগ করেন।তারা সবাই নিজ নিজ এলাকায় প্রোগ্রাম আয়োজনে করতে আগ্রহী। আমরাও সর্বাত্মক সহযোগিতার করি।

আমার মনে পড়ে, নিউইয়র্ক থেকে প্রায় সাড়ে ৭’শ মাইল নিজে ড্রাইভ করে শিল্পীদের নিয়ে শিকাগো অনুষ্ঠান স্থলে যাই। তারপর মিশিগান।

সর্বত্রই প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস দেখেছি, দেশের সংস্কৃতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখেছি তা আজও চোখের সামনে ভেসে এলে আনন্দে আপ্লুত হই।

হ্যাঁ, প্রথম আয়োজনের পেছনে আমার বা আমাদের কারোই কোন বাণিজ্যিক অভিলাস ছিলো না। আমরা কেবলই চেয়েছিলাম বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের সমৃদ্ধ শিল্প-সংস্কৃতিকে বহির্বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে।পরবর্তীতে শাকিলা জাফর, তপন চৌধুরী,আব্দুল জব্বারসহ অনেক গুণী শিল্পীদের নিয়ে বহু অনুষ্ঠান আয়োজন করেছি।

যা বলছিলাম, সেই যে ১৯৮৮ সাল থেকে ফকির আলমগীরের সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক তা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অটুট ছিলো। ফকির আলমগীর আমেরিকায় এলে অবশ্যই আমার সাথে যোগাযোগ করতেন, ঠিকানায় এসে আড্ডায় মেতে উঠতেন। ঠিকানার সাফল্যে গর্ববোধ করতেন। আমিও ঢাকা গেলে তার আতিথেয়তা গ্রহণে কোন দ্বিধা করতাম না।

ফকির আলমগীর এখন কেবলই স্মৃতি। তিনি আর কখনোই আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। উদাত্ত্ব কণ্ঠে গেয়ে উঠবেন না “ ও সখিনা গেসোছ কিনা ভুইলা আমারে…” কিংবা “মায়ের একধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম পাপোশ বানাইলে ঋণের শোধ হবে না এমন দরদি ভবে….” মহান আল্লাহ তাকে বেহেস্তবাসী করুন।

এম এম শাহীন, সাবেক সংসদ সদস্য, মৌলভীবাজার-২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *