কুলাউড়ায় “বিশ ভাই গ্রুপ” প্রধান ইউপি সদস্য রউফের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই

স্টাফ রিপোর্টার : কুলাউড়ায় হাজিপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি সদস্য শেখ আব্দুর রউফ এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। তিনি ইউপি সদস্য হওয়ার আগে ছিলেন চা বিক্রেতা। এরপর জনপ্রতিনিধির খাতায় নাম লেখান তিনি। স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে টানা ৯ বছর ইউপি সদস্য থেকে এখন হয়েছেন কোটিপতি।

তাছাড়া স্থানীয় এলাকায় “বিশ ভাই গ্রুপ” নামে একটি গ্রুপ রয়েছে তাঁর। উক্ত “বিশ ভাই গ্রুপ” এর প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউপি সদস্য রউফ। যে গ্রুপের মাধ্যমে চুরি থেকে সব কাজই এই গ্রুপের মাধ্যমে পরিচালিত হতো বলে জানা গেছে। এলাকার নিরিহ ও সংখ্যালঘু পরিবারের গরু-মহিষের পা ভেঙ্গে আহত করা “বিশ ভাই গ্রুপ” এর কাজ। আবার আহত পশু তার গ্রুপ সদস্যরা স্বল্প দামে কিনে নিয়ে যায় এমন গুঞ্জন রয়েছে হাজিপুর ইউনিয়নের সর্বত্র।

এলাকাবাসী জানায়, তাঁর ইচ্ছামাফিক চলে ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সকল কাজ। যে কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেতে আগে তাকে খুশি করতে হয়। বিধবা বয়স্ক প্রতিবন্ধী ভাতার বই, নলকূপ এগুলো পেতে নগদ ৪/৫ হাজার টাকা দিতে হয় ইউপি সদস্যকে। তাকে টাকা দিলে ৫০ বছর বয়সী একজন পেয়ে যান ভাতার বই। আর টাকা না দিলে ৮০ থেকে ৯০ বছরের বয়স্কদের কপালে জুটে না সরকানি অনুদান ভাতা।
এলাকার কোনো লোক মামলায় পড়লে নিজেকে সরকারি দলের নেতা দাবি করে বড় বড় নেতাদের ম্যানেজ করার অজুহাতে এই শেখ আব্দুর রউফ হাতিয়ে নেন মোটা অংকের টাকা। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনু বাজারে নৌকা মার্কার কথিত অফিস পোড়ানোর দায়ে মামলা হয়। এ সময় নেতাকর্মীরা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ইউপি সদস্য রউফ নেমে যান পুরনো ব্যবসায়। মামলার ভয় দেখিয়ে বিএনপি-জামায়াতের অনেক লোকের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেন বলে বেশ কয়েক জনের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সালিস বৈঠকে ঘটনার নিষ্পত্তির আগে সমঝোতা করে উভয় পক্ষের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ থেকেও অংশ নিয়ে যান ইউপি সদস্য। এলাকায় রাস্তাঘাট উন্নয়নে নামমাত্র কাজ করে প্রকল্পের পুরো টাকাই উত্তোলন করে নেন। কেউ কোনো প্রতিবাদ করলে মামলা ও তার নিজেস্ব বাহিনীর ভয় দেখান। ফলে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।
এছাড়া গেল করোনার পরিস্থিতির ১ম ধাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত মানবিক সহায়তা তালিকায় ২৫০০ টাকার সহায়তা প্রকল্পে ৪০-৫০ জন উপকারভোগীর সঙ্গে তাঁর সমঝোতা রয়েছে বলে জানা গেছে। এই উপকারভোগীরা টাকা উত্তোলনের পর মেম্বারকে টাকার একটা অংশ দেবেন বলে এমন নিশ্চয়তা পেয়েই তাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন।

এছাড়া তালিকা প্রণয়নে করেছেন অনেক ইউপি সদসের স্বজনপ্রীতি। কয়েকটি পরিবারে যারা সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে ওই সকল পরিবারের সদস্যদের নাম দিয়েছেন ২৫০০ টাকার তালিকায়। এ বিষয়ে স্থানীয় গত ১১/০৬/২০২০ তারিখ এলাকার আরাফ উদ্দিন, আব্দুল আজিজ ও আব্দুল হান্নান কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অন্যদিকে হাজীপুর ইউনিয়নের রনচাপ গ্রামের অমরেন্দ্র সরদারের বাড়ির সম্মুখ হইতে রনচাপ গ্রামের রমুজ আলীর বাড়ি পর্যন্ত ২০১৯-২০ অর্থ বছরের কর্মসৃজন কর্মসূচি প্রকল্পের আওতায় রাস্তা উন্নয়নের কাজ ৬ জন শ্রমিক দিয়ে ৫/৬ দিন সামান্য কাজ করে প্রকল্প চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাধে প্রায় দুই লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া কাজের সরকারি সাইনবোর্ড রাস্তায় এক দিন রেখে পরের দিন সাইনবোর্ড তুলে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে স্থানীয় রনচাপ গ্রামের বরুন রায়, ইন্দ্রজিৎ দাশ খোকন, সুধাংশু মল্লিক বাবুল গংসহ শতাধিক ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে পাঠানো হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, ২০১৪ সালে হরতাল অবরোধের সময় টিলাগাঁও ইউনিয়নের চকসালন এলাকায় ট্রেন লাইনচ্যুত হলে মাতাব গ্রামের হান্নান মিয়াকে মামলায় জড়িয়ে দেন ইউপি সদস্য শেখ আব্দুর রউফ। এতে ওই পরিবার বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
এলাকার রহমান মিয়া জানান, ২০১৪ সালে হরতাল অবরোধের সময় টিলাগাঁও ইউনিয়নের চকসালন এলাকায় ট্রেন পড়লে তাঁর ভাই হান্নান মিয়াকে মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ইউপি সদস্য আব্দুর রউফ এর বিশ ভাই গ্রুপ হাতিয়ে নেয় ৪-৫ লাখ টাকা। এভাবে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি করে গত ৯ বছরে ইউপি সদস্য এখন কোটিপতি।
তাঁর এমনসব কর্মকাণ্ডে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি অভিযোগ দিয়েছে রণচাপ এলাকাবাসী। এরপর থেকেই সর্বত্র শুরু হয়েছে আলোচনা। অনেকেই শেখ আব্দুর রউফের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে এবং অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে দুদকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত ইউপি সদস্য শেখ আব্দুর রউফ তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি কোনোদিন জনগণের কাছ থেকে একটি টাকাও নেইনি বা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না। প্রকৃত লোকদের আমি প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় নাম অর্ন্তভুক্ত করেছি। আর রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে, পুরো বিল দেয়া হয়নি। আমাকে সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য একটি পক্ষ এসব ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।
সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বয়স্ক ভাতার ক্ষেত্রে পুরুষদের জন্য নির্ধারিত বয়স ৬৫ এবং নারীদের জন্য ৬২ বছর। এলাকাবাসীর দেওয়া অভিযোগ থেকে জানা গেছে, হাজীপুরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চক রনচাপ গ্রামের বাসিন্দা লক্ষ্মী রানী মালাকার (৪১), আবদুল মনাফ (৫৮), উম্মর আলী (৬২), খয়রুন বেগম (৪৩), শশাঙ্ক মালাকার (৪৭), জ্যোতির্ময় মালাকার (৫৩) ও রাইমন মালাকার (৫৫) বয়স্ক ভাতার সুবিধাভোগী। একই ওয়ার্ডের রনচাপ গ্রামের পঙ্কজ রুদ্রপাল (৫৮), সুজন মিয়া (৬২), আবুল মিয়া (৬৩), আসিক মিয়া (৫৬), শৈলেশ দে (৬৪), আবদুল করিম (৬৪), আছকির মিয়া (৫২), মালেকা বেগম (৫০), অনীল রায় (৫৪), পরমেশ চন্দ্র দে (৫৫) ও ভোভেন্দ্র দে (৫৩) দীর্ঘদিন ধরে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন।
এ ছাড়া মাতাবপুর গ্রামের শফিক মিয়া (৬০), পনুয়া রবিদাস (৫০) ও সিরাজ মিয়া (৫৩), গাজীপুর গ্রামের আবদুল মুকিত চৌধুরী (৫০), তুকলি গ্রামের মাহমুদ আলী (৬৪), নিরঞ্জন মালাকার (৬৪) ও আবদুর রহিম (৫৪), ইসমাঈলপুর গ্রামের আবদুল বাছিত (৫৩), খালিক মিয়া (৫৮) ও মনসুর মিয়া (৫৫) এবং মনু বাজার এলাকার পানমতি দাস (৫৫) বয়স হওয়ার আগে থেকেই বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন।
অভিযোগটি তদন্তের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) দায়িত্ব দেন জেলা প্রশাসক। ইউএনও বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে।
সমাজসেবা কর্মকর্তা ইব্রাহিম গত ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে জানান, সরেজমিনে তদন্তে নির্ধারিত বয়সের কম কয়েকজন ভাতা পাচ্ছেন বলে তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। তাদের ভাতা ২০১১,২০১২ ও ২০১৩ সালে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ রকম ভাতার বই জব্দ করে অগ্রনী ব্যাংক কটারকোনা শাখায় চিটি দিয়ে স্থগিত করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে জমা দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ইউপি সদস্য শেখ আব্দুর রউফ এর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এখন অনলাইনে ভাতার তথ্য পূরণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত বয়সের কম উল্লেখ করলে অনলাইন সেটা গ্রহণ করবে না। অতীতে কিছু অনিয়ম ঘটতে পারে। তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।-সূত্র-সাপ্তাহিক পাতাকুড়ির দেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *