উচ্চ শিক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া কাল হলো কুলাউড়ার ঝর্ণার

বিশেষ প্রতিনিধি : নুরুননাহার চৌধুরী ঝর্ণা নামের এক সমাজকর্মী সম্প্রতি আইন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে তিনি তাঁর সামাজিক সংগঠনের চেয়ারম্যানের সাথে ছবি তুলেন। সেই ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে তাঁর নিজ এলাকায় নানা অপবাদ প্রচার করে একটি গোষ্ঠী। স্থানীয়দের দাবি, ঝর্ণা চৌধুরী নাকি নাস্তিক হয়ে গেছেন। আর এটা নিয়ে নিজ এলাকার মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটিসহ লোকজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অপবাদ তুলে তাঁর পরিবারকে সমাজচ্যুত করার জন্য মসজিদে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন। এমন ঘটনাটি মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ভাটেরা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের। এ ঘটনায় ঝর্ণাসহ তাঁর পরিবার সামাজিকভাবে চাপে আছেন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ঝর্ণার পিতা হাজী আব্দুল হাই চৌধুরী সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন থেকে রক্ষা পেতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। যার অনুলিপি কুলাউড়া থানার ওসি এবং কুলাউড়ায় কর্মরত সাংবাদিকদের কাছে দেয়া হয়েছে।
অভিযোগ ও ভুক্তভোগীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ভাটেরার কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা হাজী আব্দুল হাই চৌধুরী (৭০)। তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। এর মধ্যে ঝর্ণা চৌধুরী দ্বিতীয় সন্তান। ঝর্ণা চৌধুরী ২০০৮ সাল থেকে “পজিটিভ জেনারেশন অব সোসাইটি বাংলাদেশ” নামের একটি অরাজনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক, অলাভজনক সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়। ২০১৩ সাল থেকে সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ঝর্ণা নারী অধিকার, নারী শিক্ষা নিয়ে স্থানীয়ভাবে নানারকম কর্মসূচী হাতে নিয়ে কাজ শুরু করে। আর এজন্য এলাকার কিছু মানুষ বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে নিয়েছিলেন। সিলেটে পড়াশুনার সময় এলাকার মানুষ ঝর্ণাকে নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার শুরু করেন ফেসবুকে। ঝর্ণা সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ¯œাতক সম্পন্ন করে গত ২৬ ডিসেম্বর উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে তাঁর সংগঠনের চেয়ারম্যান জয়তূর্য চৌধুরীসহ কয়েকজন বিমানবন্দর থেকে তাকে রিসিভ করে তার সাথে তোলা ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করেন। এরপর ঝর্ণার গ্রামের কিছু মানুষ তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া ও এমনসব ছবি তুলে ফেসবুকে প্রকাশ এবং তাঁর জীবনাচরণ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন ফেসবুকে। বিষয়টি নিয়ে গত ৮ জানুয়ারি সিলেটের শাহপরাণ থানায় একটি জিডি করেন ঝর্ণার বাবা আব্দুল হাই চৌধুরী। এদিকে ঝর্ণার পরিবারকে নিয়ে এলাকায় বিভিন্ন অপপ্রচার ছড়িয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এলাকার পঞ্চায়েতের লোকজন আব্দুল হাই চৌধুরীর কাছে জানতে চান তাঁর মেয়ে ঝর্ণা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে হিন্দু ছেলে জয়তূর্য চৌধুরীর সাথে চলাফেরা এবং ছোট কাপড় কেন পরিধান করেন। মেয়ের এমন জীবনাচরণের কারণে তাঁকে এক ঘরে করার হুমকিও দিতে থাকেন।
এরপর স্থানীয় ভাটেরা বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সামছুল ইসলাম মাখন ও সাধারণ সম্পাদক আমিন মিয়া, কৃষ্ণপুর এলাকার বাসিন্দা শেখ টি এম মাছুম, এলাকার মুরব্বী বাবলু মিয়া, পংকি মিয়া, পাখি মিয়াসহ অনেকে ঝর্ণার বিচার করার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। ঝর্ণার বাবাকে পঞ্চায়েত কমিটির সভায় উপস্থিত থাকার জন্য চাপ দিচ্ছিল। এমনকি মেয়ের হয়ে তাঁর বাবাকে দোষ স্বীকার করে বক্তব্য দিতে বলেছিল। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় তাদের ডাকে সভায় যেতে পারিনি ঝর্ণার বাবা। বৈঠকে না যাওয়াতে গত শুক্রবার (২৮ জানুয়ারি) মসজিদে সভা করে ঝর্ণার বাবাকে সমাজচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেন মসজিদ কমিটির লোকজন। সেই সিদ্ধান্তটি গত শুক্রবার টি এম মাছুম নামের এক ব্যক্তি তাঁর ফেসবুকে পোস্ট করে প্রচার করেছে। পোস্ট করার পর সমাজচ্যুতের বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ঝর্ণার বাবা আব্দুল হাই চৌধুরী বলেন, আমার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ায় এলাকার কিছু লোকজন অতি উৎসাহী হয়ে তাঁকে ও আমার পরিবারকে জড়িয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার শুরু করেন। মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি শামসুল ইসলাম মাখন ও সম্পাদক আমীন আলী আমাকে গত শুক্রবার (২৮ জানুয়ারি) কমিটির শালিসী বৈঠকে গিয়ে আমার মেয়ের এরকম চলাফেরার জবাব দিতে বলেন। আমি অসুস্থ থাকায় বৈঠকে যেতে পারিনি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁরা আমাদেরকে সমাজচ্যুত করে একঘরে করার সিদ্ধান্ত নেন। এমন সিদ্ধান্ত ও মিথ্যা অপপ্রচারের ছড়ানোয় আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছি। আমার পরিবারকে সামাজিকভাবে হুয়রানি করা হচ্ছে। এখন সামাজিকভাবে আমাদের মর্যাদাহানি হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ঝর্ণা চৌধুরী মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি কি পোশাক পরবো, কার সাথে ছবি তুলবো, কার সাথে চলবো বা চলবো না সেটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অধিকার। সেটা তো আমাকে এলাকার লোক নির্ধারণ করে দিতে পারেনা। কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে অনাধিকার চর্চা করার অধিকার কারো নেই। ‘আমি যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর আমি ছোট কাপড় পরছি, কার সাথে ছবি তুলছি, নাস্তিক হয়ে গেছি মিথা অপবাদ দিয়ে ফেসবুকে এমন কুৎসা রটাতে থাকে ভাটেরার স্থানীয় একটি মৌলবাদী গোষ্ঠি।
ঝর্ণা জানান, এ খবর পেয়ে তিনি মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সেক্রেটারি আমিন মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ঝর্ণা বলেন, ‘আমি তাকে জিজ্ঞেস করি আমার এবং আমার বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী? জবাবে তিনি জানান, আমি যুক্তরাষ্ট্রে এসে আমার এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বী একজনকে বিয়ে করেছি। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমার বাবা ইতোমধ্যে তিনবার স্ট্রোক করেছেন, স্মৃতিভ্রম রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসক বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাছাড়া আমার বাবা কেন তাদের নির্দেশ মানেননি, তাই মসজিদ কমিটির লোকজন অতি উৎসাহী হয়ে অনধিকার চর্চার মাধ্যমে আমার পরিবারকে এক ঘরে করে দেয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমার মনে হচ্ছে, এসব নারীবিদ্বেষীদের, মৌলবাদীদের অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম। কারণ আমরা দেখেছি যারাই এসব করছে তারা কোন না কোন ভাবেই স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছের লোক। বিষয়টি আমি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে জানাই। তখন তিনি গুরুত্বসহকারে বিষয়টির ব্যবস্থা নেননি। এজন্য ওই গোষ্টি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আমাকে ও আমার পরিবারকে নিয়ে মিথ্যা অপপ্রচার করছে।
মসজিদ কমিটির সভাপতি শামছুল ইসলাম মাখন ও সম্পাদক আমিন মিয়া বলেন, ঝর্ণার এমন চলাফেরা নিয়ে পঞ্চায়েতের লোকজন আমাদেরকে চাপ দিতে থাকেন। আমরা কমিটির লোকজন তাঁর বাবার কাছে মাস খানেক সময় ধরে বিষয়টি জানতে চাই। তিনি আমাদের সাথে আর কোন যোগাযোগ করেননি। গত শুক্রবার (২৮ জানুয়ারি) পঞ্চায়েতের লোকজন মসজিদে বসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। আমরা তাঁদের সমাজচ্যুত করিনি। তিনি পঞ্চায়েতকে গুরুত্ব দেননি সেহেতু উনি উনার মতো করে চলবেন। আমরা আমাদের মতো চলবো।
স্থানীয় ভাটেরা ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ একেএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কারো ব্যক্তিগত চলাফেরা নিয়ে কথা বলার অধিকার কেউ রাখেনা। ঝর্ণাকে নিয়ে আগে যারা অপপ্রচার চালিয়েছে তাঁদেরকে আমি সতর্ক করে দিয়েছি। এখন ঝর্ণার পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা দিতে আমি খোঁজখবর রাখছি। আজ মঙ্গলবার ইউএনও মহোদয়সহ আমরা পরিষদের সভাকক্ষে সবাইকে নিয়ে বসে বিষয়টি সমাধান করবো।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি জেনে তাৎক্ষণিক মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ও সম্পাদককে সতর্ক করে দিয়েছি ঝর্ণার পরিবারকে যাতে হয়রানী না করা হয়। পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে থানার ওসি ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকেও নির্দেশ দিয়েছি নজর রাখতে। বিষয়টি নিয়ে উভয়পক্ষকে নিয়ে বসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *