বিশেষ প্রতিনিধি : কুলাউড়ায় উচ্চ শিক্ষার্থে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ায় নুরুননাহার চৌধুরী ঝর্ণা নামের এক শিক্ষার্থীর পরিবারকে মিথ্যা অভিযোগ এনে ‘সমাজচ্যুত’ করার দায় স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে মুচলেকা দিয়েছেন স্থানীয় মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি-সম্পাদকসহ নেতৃবৃন্দ। এর আগে স্থানীয় এক ব্যক্তি শিক্ষার্থীর পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে মর্মে ফেসবুকে একটি পোস্ট করলে বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে কালের কণ্ঠসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এছাড়া দেশ ও প্রবাসে অবস্থানরত ওই শিক্ষার্থীর সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ শোভাকাঙ্খীরা বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান।
এর আগে ৩১ জানুয়ারি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ঝর্ণা চৌধুরীর বাবা কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা হাজী আব্দুল হাই চৌধুরী (গুলাব) সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন থেকে রক্ষা পেতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাতে স্থানীয় ভাটেরা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ভাটেরা বাজার কেন্দ্রীয় মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি-সম্পাদকসহ সকল সদস্য ও ভুক্তভোগী পরিবারকে নিয়ে সমাধানের জন্য জরুরী বৈঠক করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চৌধুরী। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিনয় ভূষণ রায়, ভাটেরা ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ একেএম নজরুল ইসলাম, ওসি (তদন্ত) মো. আমিনুল ইসলাম, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ঝর্ণা চৌধুরীর বাবা আব্দুল হাই চৌধুরী, ভাটেরা বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি শামছুল ইসলাম মাখন ও সম্পাদক আমিন মিয়া প্রমুখ।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুঠোফোনে ঝর্ণা চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে আমি মানসিকভাবে চাপে ছিলাম। বিষয়টির সুন্দর সমাধান করে দেয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি কুলাউড়ার ইউএনও মহোদয়, গণমাধ্যমকর্মী ও স্থানীয় প্রশাসনকে। এছাড়া আমার এই দুঃসময়ে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বোচ্ছার ছিলেন তাদের প্রতিও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
স্থানীয় ভাটেরা ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ একেএম নজরুল ইসলাম বলেন, ইউএনও স্যারের আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে বিষয়টির সুন্দর একটি সমাধান হয়েছে। এছাড়া যে ব্যক্তি সমাজচ্যুতের বিষয়টি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলও সেও ঝর্ণার বাড়িতে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে এসেছে। আর যাতে কেউ ওই পরিবারকে নিয়ে কোন অপপ্রচার না করতে পারে সেজন্য আমরা সবসময় নজরদারি রাখবো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বুধবার মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘মঙ্গলবার স্থানীয় ভাটেরা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে দুই পক্ষের উপস্থিতিতে বৈঠকে নিজেদের ভূল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক। মেয়েটির বাবাও তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে এরকম কর্মকা- থেকে বিরত থাকবেন এই মর্মে মসজিদ কমিটির সকল সদস্যরা মুচলেকা দিয়েছেন। এছাড়া ওই পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তায় কমিটির লোকজন পাশে থাকবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। শিক্ষার্থী ঝর্ণার পরিবারও এই রায়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন, সন্তুষ্টিতে ঝর্ণার বাবা গুলাব চৌধুরীও লিখিত দিয়েছেন। সবাই সামাজিক সহমর্মিতা বজায় রেখে চলবেন।’
তিনি আরো বলেন, পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক জানান তাঁরা বয়স্ক মানুষ, তাই ইন্টারনেট চালাতে পারেন না। এলাকায় চাউর হয়ে যায় যে, ঝর্ণা চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে একজন হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করেছে। তাই তাঁর বাবা আব্দুল হাই চৌধুরীকে মসজিদ কমিটি বৈঠকের জন্য ডাকেন। কিন্তু উনি না আসায় তাঁরা বলেন যে উনি উনার মতো চলুক, আমরা আমাদের মতো চলব।’
ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ‘আমি যখনই বিষয়টি জানতে পারি তখনই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও থানার ওসিকে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ওই পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিতে বলি। মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সম্পাদককে সতর্ক করে দেই। পরবর্তীতে দুই পক্ষকে নিয়ে দ্রুত বৈঠক করে সুন্দর সমাধান করে দেই।
প্রসঙ্গত, নুরুননাহার চৌধুরী ঝর্ণা ২০০৮ সাল থেকে “পজিটিভ জেনারেশন অব সোসাইটি বাংলাদেশ” নামের একটি অরাজনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক, অলাভজনক সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়। ২০১৩ সাল থেকে সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ঝর্ণা নারী অধিকার, নারী শিক্ষা নিয়ে স্থানীয়ভাবে নানারকম কর্মসূচী হাতে নিয়ে কাজ শুরু করে। আর এজন্য এলাকার কিছু মানুষ বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে নিয়েছিলেন। সিলেটে পড়াশুনার সময় এলাকার মানুষ ঝর্ণাকে নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার শুরু করেন ফেসবুকে।
ঝর্ণা সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে গত ২৬ ডিসেম্বর উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে তাঁর সংগঠনের চেয়ারম্যান জয়তুর্য চৌধুরীসহ কয়েকজন বিমানবন্দর থেকে তাকে রিসিভ করে তার সাথে তোলা ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করেন। এরপর ঝর্ণার গ্রামের কিছু মানুষ তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া ও এমনসব ছবি তুলে ফেসবুকে প্রকাশ এবং তাঁর জীবনাচরণ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে ফেসবুকে নানা অপবাদ প্রচার করেন। স্থানীয়দের দাবি, ঝর্ণা চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে জয়তুর্যের সাথে চলাফেরা করছেন কেন, কেন ছোট কাপড় পড়েন, কপালে টিপ দেন, তাই সে নাকি নাস্তিক হয়ে গেছেন। আর এটা নিয়ে নিজ এলাকার মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি শামছুল ইসলাম মাখন ও সম্পাদক আমিন মিয়াসহ লোকজন গত ২৮ জানুয়ারি শুক্রবার মসজিদে বৈঠকে করে বিভিন্ন অপবাদ তুলে তাঁর পরিবারকে সমাজচ্যুত করার জন্য মসজিদে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঝর্ণার বাবা অসুস্থ থাকায় বৈঠকে যেতে পারিনি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কমিটির লোকজন সমাজচ্যুত করে একঘরে করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্তটি গত শুক্রবার টি এম মাছুম নামের এক ব্যক্তি তাঁর ফেসবুকে পোস্ট করে প্রচার করেছে। পোস্ট করার পর সমাজচ্যুতের বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ঝর্ণাসহ তাঁর পরিবার সামাজিকভাবে চাপে ছিলেন।