এক সংগ্রামী ভাষা সৈনিক কমরেড আব্দুল মালিকের চিরবিদায়

জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার :

ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বর্ষীয়ান রাজনৈতিক কমরেড আব্দুল মালিক আর বেঁচে নেই। ৮৮ বছর বয়সে ১৩ জুন সোমবার ভোর সোয়া ৫টার দিকে উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের পৃথিমপাশা গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। পরিবার ও স্বজনদের সূত্রে জানা যায়, আব্দুল মালিক দীর্ঘদিন ধরে বার্ধ্যক্য ভূগছিলেন। সোমবার বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে স্থানীয় রবিরবাজার জামে মসজিদের ঈদগাহ্ প্রাঙ্গণে জানাজার নামাজ শেষে পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। কমরেড আব্দুল মালিক ১৯৩৪ সালের ২৩ জুন কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের পৃথিমপাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম মো. ইলিম এবং মা মরহুমা ছবরুননেছা খাতুন। জীবদ্দশায় তিনি বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্ঠামন্ডলীর সদস্য ও কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।

আব্দুল মালিক ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের খবর বেতারের মাধ্যমে জানতে পেরে তিনিসহ আরো কয়েকজন একত্রে স্থানীয়ভাবে আন্দোলনে নামেন। যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয় তখন তিনি আলী আমজদ স্কুলে ছাত্র থাকাবস্থায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্কুলে ক্লাস বর্জনসহ স্থানীয় রবিরবাজারে মিছিল, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৯৬২ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে নেমে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় ৪ মাস কারাবরণ করেন। পরে মার্শাল কোর্টে বাবা এবং ভাইয়ের অঙ্গীকার মাধ্যমে খালাস পান। তারপরও ১৯৬৯’র গণআন্দোলনে নিজেকে সক্রিয় রাখেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অস্ত্র হাতে না নিলেও আগরতলা আশ্রয়কেন্দ্র এবং বাংলার মুক্তিসেনাদের মধ্যে গুপ্তচরের ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন রসদ যোগান, খবরা-খবর আদান-প্রদান করেন। কুলাউড়া দক্ষিণাঞ্চলের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন সংগঠক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন কমরেড আব্দুল মালিক। প্রথমে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের পৃথিমপাশা সভাপতি এবং উপজেলা সদস্য হিসেবে এলাকার মেধাবী তরুণদের সংগঠিত এবং রাজনীতিতে সক্রিয় করেন। কমরেড আব্দুল মালিক এ দেশের পুরোধা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ বহু গুণধর ব্যক্তি ও রাজনীতিকের সাহচর্চে ধন্য হয়েছেন। গরীব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের বীর মাওলানা ভাসানীর ন্যাপের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নবাব আলী সফদর খান রাজা সাহেবের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। কমরেড আব্দুল মালিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হিসাবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে ফরিদপুর জেলার অম্বিকা ময়দানে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় ‘কৃষক সম্মেলনের’ উদ্বোধক ছিলেন। কমরেড আব্দুল মালিক শুধু রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেননি, শিক্ষাঙ্গনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। কর্মধা ইউনিয়নের কর্মধা উচ্চ বিদ্যালয় এবং পাট্টাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি রাউৎগাঁও শম্ভুনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পৃথিমপাশার ভাটগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইটাহরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন, যা পরবর্তীতে সরকারিকরণ হয়। চলতি বছরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে কমরেড আব্দুল মালিককে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভাষা আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা রাখায় বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *