মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা-শ্রমিকদের কর্মবিরতি, সড়ক অবরোধ

জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে মৌলভীবাজারের জুড়ী ও লংলা ভ্যালির ৭০টি চা-বাগানে দ্বিতীয় দিনের মতো শ্রমিকেরা কর্মবিরতি পালন করেছেন। ১০ আগস্ট বুধবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা এ কর্মবিরতি পালিত হয়। এ সময় কয়েকটি স্থানে শ্রমিকেরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার মোট ৩৬টি বাগানে কর্মবিরতি পালিত হয়েছে। কাল বৃহস্পতিবারও এ কর্মসূচি চলবে।

শ্রমিকদের সূত্রে জানা গেছে, চা-শ্রমিকদের সংগঠন চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে চা-বাগানের মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা-সংসদের করা চুক্তি অনুযায়ী, চা-শ্রমিকদের মজুরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ হয়। প্রতি দুই বছর পর পর এ চুক্তি সম্পাদনের কথা। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন হয়। ওই চুক্তিতে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আর নতুন করে চুক্তি হয়নি। সম্প্রতি চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে  বাংলাদেশীয় চা-সংসদ মজুরি ১৪ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু, নেতারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। শ্রমিকদের মজুরি ৩০০ টাকা নির্ধারণসহ অন্যান্য দাবি-দাওয়া পূরণের বিষয়ে ১ আগস্ট চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশীয় চা-সংসদের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। চিঠিতে দাবি মেনে নিতে সাত দিনের সময়সূচী বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, এ সময়ের মধ্যে দাবি না মানায় সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সরেজমিনে বুধবার বেলা ১০টার দিকে দেখা গেছে, জুড়ীর রত্না চা-বাগানের কারখানার সামনে ৭০০-৮০০ শ্রমিক নারী-পুরুষ জড়ো হয়ে কর্মবিরতি পালন করছেন। সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন, রত্না বাগান শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সুমন ঘোষ ও এলাপুর ফাঁড়ি বাগান কমিটির সভাপতি চন্দন চাষা। পরে শ্রমিকেরা জুড়ী-বটুলী শুল্ক স্টেশন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে তাঁরা বিভিন্ন শ্লোগানও দেন। এদিকে কুলাউড়ার লুয়াইউনি-হলিছড়া চা-বাগানের শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে কর্মবিরতি পালন করেন।

এই রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে চা বাগানে কাজ করে এক লিটার সোয়াবিন তেলের দামও পাইনা বলে অভিযোগ করেন কুলাউড়ার একটি চা-বাগানের শ্রমিক কলতি রবিদাস। তিনি বলেন সবকিছুর দাম বাড়ে শুধু আমাদের মজুরি বাড়ে না। এই মজুরি না বাড়ার কারণে উপোষ থাকতে হয় প্রায়ই। প্রত্যেকদিন কিছু না কিছুর দাম বাড়ছেই কিন্তু বাড়ে না শুধু আমাদের মতো নিরীহ চা শ্রমিকদের মজুরী।

একই সাথে কাজ করেন সুখিয়া কৈরি। তিনি বলেন, আমার স্বামী বাজারে যা কিনতে যায়। সেটার নাকি দাম বেড়ে গেছে শুনি। কিন্তু নগদ মজুরি বাড়ে দুই বছর আগে ১২০ টাকা ছিল এখনো সেটায় রয়েছে। দুই কেজি চাল কিনলে ১২০ টাকার আর কিছুই থাকে না। পাঁচ জনের সংসার আমাদের। কোনদিকে আমাদের আয় উপায় নেই। কি করবো বুঝতে পারি না। জিনিসপত্রের দাম কম থাকায় আগে মজুরি কম থাকলেও বুঝতে পারতাম না। কিন্তু এখন না বুঝার কোন উপায় নাই। এখন দোকানে এককাপ চা রং খাইলেওতো ১০টাকা দেওয়া লাগে। সেটা ছয়মাস আগে ছিল ৫ টাকা। তিনি বলেন, কারও কাছেতো আমরা ভিক্ষা চাচ্ছি না। শুধু আমাদের কাজের মুল্যায়ন চাচ্ছি।

চা-শ্রমিক ইউনিয়নের জুড়ী ভ্যালি কমিটির সভাপতি কমল চন্দ্র বুনার্জি বলেন, তাঁদের আওতাধীন জুড়ী, বড়লেখা ও কুলাউড়া উপজেলার মোট ৩৬টি বাগানে কর্মবিরতি পালিত হয়েছে। ১১ আগস্ট বৃহস্পতিবারও এ কর্মসূচী চলবে। এরপর সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পরবর্তী কর্মসূচী নেওয়া হবে।

সংগঠনের লংলা ভ্যালি কমিটির আওতায় কুলাউড়া উপজেলার ৩৪টি বাগান রয়েছে। ভ্যালি কমিটির সাধারণ সম্পাদক সঞ্জু গোস্বামী বলেন, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দিন দিন বেড়ে চলেছে। বেড়েছে অন্যান্য খরচও। কিন্তু, তাঁদের মজুরি বাড়েনি। মজুরি ৩০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি করেন।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক নিপেন পাল জানান, দেশ-বিদেশে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি বিবেচনা করে নূন্যতম মানবাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার দিতে হবে। চা শ্রমিকের হাজিরা ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় উন্নীত করার দাবি অনেক দিনের। মালিকপক্ষ ইতিমধ্যে ১৪ টাকা বর্ধিত করার প্রস্তাব দিয়েছে। ১৪ টাকা বৃদ্ধি হলে একজন শ্রমিকের মজুরী হবে ১৩৪ টাকা। এই ১৩৪ টাকা দিয়ে কীভাবে একজন শ্রমিকের জীবন চলবে? সারাদিন পরিশ্রম করে এক লিটার পেট্রোলের দামও হবে না।

চা-শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশীয় চা-সংসদের চেয়ারম্যান মো: শাহ আলম গণমাধ্যমকে জানান, ‘আমাদের ক্যাপসিটি অনুযায়ী, মজুরি ১৪ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলাম। অনেক বাগান লসে আছে। চায়ের বাজার ভালো নয়। এখন জ্বালানি তেলের দামও বেড়ে গেছে। শ্রমিকদের রেশনের আটা দেওয়া হয়। প্রতি কেজি গমের দাম ১৪ টাকা থেকে বেড়ে ২৮ টাকা হয়ে গেছে।  এসবও তো ভাবতে হবে।’

চা বাগান মালিকদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট ব্র্যাঞ্চ চেয়ারম্যান এবং ফিনলে টি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) গোলাম মোহাম্মদ শিবলি জানান, চা শ্রমিকদের বেতন নির্ধারণের জন্য সরকার একটি মজুরি বোর্ড গঠন করেছে। আলোচনা চলমান রয়েছে। আমরা মজুরী বৃদ্ধির কথাও বলেছি। তিনি বলেন, যেহেতু মজুরি বোর্ড কাজ করছে, সেহেতু হঠাৎ করে শ্রমিকদের কর্মবিরতি কর্মসূচি অযৌক্তিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *