সিলেট সদর উপজেলার একটি মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির পর অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আগের শিক্ষককে বাদ দিয়ে উৎকোচের বিনিময়ে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ ওঠেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন হাউসা ফুরকানিয়া ইরফানিয়া আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আজিজ আহমদ। যিনি আসল কাগজপত্র গায়েব করে জাল কাগজপত্র তৈরি করে নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। বঞ্চিত করেছেন কর্মরত শিক্ষককে। ফলে সন্তান-সন্ততি নিয়ে চরম অর্থকষ্টে রয়েছেন চাকুরীহারা শিক্ষক মাওলানা কবির আহমদ। এ বিষয়ে তিনি ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগপত্র প্রেরণ করেছেন।
অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, সিলেট সদর উপজেলার মোগলগাঁও ইউনিয়নের মোবারকপুর (মৌলভীরগাঁও) গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা কবির আহমদ ২০১৪ সালে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হাউসা ফুরকানিয়া ইরফানিয়া আলিম মাদরাসার আরবি প্রভাষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তিনি নিয়মিত মাদরাসায় যেতেন। কিছু দিন পর আর্থিক সংকট দেখিয়ে অধ্যক্ষ বেতন ভাতা আপাতত দেয়া যাবে না জানিয়ে মাঝে মাঝে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কবির আহমদ অধ্যক্ষের কথামতো মাদারাসার হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে যেতেন। এমনকি ২০১৮ সালে মাদরাসার আরবি প্রভাষক হিসেবে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন কবির আহমদ। যার কাগজপত্র তার কাছে রয়েছে। যখন অধ্যক্ষ ডাকতেন তিনি হাজির হতেন। যদিও তার সকল কাগজপত্র মাদরাসায় রক্ষিত নেই বলে অস্বীকার করছেন অধ্যক্ষ মাওলানা আজিজ আহমদ।
চলতি বছরের ৬ জুলাই হাউসা ফুরকানিয়া মাদরাসার আলিম স্তর এমপিওভুক্ত হওয়ার পর মাওলানা কবির আহমদ জানতে পারেন, তার স্থলে অন্য একজনের নাম পাঠানো হয়েছে মাদরাসা অধিদপ্তরে। সেই ব্যক্তি হচ্ছেন মাসুম আহমদ। যিনি বুরাইয়া কামিল মাদরাসায় আইসিটি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন এবং তিনি ইনডেক্সধারী শিক্ষক। মাওলানা কবির আহমদ অভিযোগ করেন, তার কাগজপত্র গায়েব করে বড় অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে মাসুম আহমদ পূর্ব থেকে মাদরাসায় কর্মরত দেখিয়ে অধিদপ্তরে কাগজপত্র প্রেরণ করেন। এমনকি মাসুম এখন কাগজপত্রে হাউসা ফুরকানিয়া আলিম মাদরাসার এমপিওভুক্ত শিক্ষক। মাসুম আহমদ এখনো বুরাইয়া কামিল মাদরাসায় এমপিওভুক্ত আইসিটি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুস সালাম।
তিনি জানান, চার মাস আগে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেছেন। আসার পর থেকে মাসুমকেই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দেখছেন। গত মাসেও মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে বেতনাদি তুলেছেন। বুরাইয়া মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজুল ইসলাম ফারুকী বলেন, বেশ কয়েক বছর থেকে মাসুম আহমদ তাদেরই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন।
সিলেট সদর উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তা মো: গোলাম রব্বানী জানান, হাউসা ফুরকানিয়া মাদরাসা এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া তার মাধ্যমেই হয়েছে। আলিম শ্রেণিতে পাঠদানের অনুমতি পাওয়ার পর থেকে যারা কর্মরত ছিলেন; তারাই এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এমপিওভুক্তির জন্য যেসব প্রক্রিয়া অবলম্বন ও কাগজপত্র প্রদর্শন করা প্রয়োজন অধ্যক্ষ সব করেছেন। অধ্যক্ষ যদি তথ্য গোপন করে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কাউকে নিয়োগ দিয়ে থাকেন, তবে এর জবাবদিহিতা তাকেই করতে হবে।
আলাপকালে হাউসা ফুরকানিয়া ইরফানিয়া আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আজিজ আহমদ মাদরাসায় আলিম ক্লাস শুরুর পর অভিযোগকারী মাওলানা কবির আহমদ ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন মর্মে স্বীকার করেন। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ননএমপিওভুক্ত থাকাকালে তিনি কর্মরত ছিলেন বলে উল্লেখ করেন। তিনি স্বীকার করেন, ওই শিক্ষক সপ্তাহে ২/৩ দিন আসতেন। ওই সময়ে মাদরাসা অধিদপ্তরে কর্মরত শিক্ষকের তালিকায় মাওলানা কবির আহমদের নামও পাঠিয়েছিলেন। তবে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাওলানা কবির আহমদকে ম্যানেজিং কমিটি রেজুলেশনের মাধ্যমে আরবি প্রভাষক পদ থেকে অব্যাহতি দেয়।
অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল আজিজ আরো জানান, ২০১৫ সালে আলিম শ্রেণির পাঠদানের অনুমতি পাওয়ার পর আরবি প্রভাষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন জানিয়ে মাসুম আহমদের নাম তিনি মাদরাসা অধিদপ্তরে পাঠান। ২০১৯ সাল পর্যন্ত যেখানে মাওলানা কবির আহমদ মাদরাসার শিক্ষকতায় সম্পৃক্ত ছিলেন; তখন মাসুম অন্য প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত কর্মচারী হিসেবে কর্মরত। সেই মাসুম আহমদের নাম কিভাবে মাদরাসা অধিদপ্তরে পাঠালেন জানতে চাইলে অধ্যক্ষ কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। এছাড়া ২০২২ সালের জুলাই মাসে আলিম শ্রেণি এমপিওভুক্ত হওয়ার পরও যিনি একদিনের জন্যও মাদরাসায় উপস্থিত ছিলেন না, তাকে শুধু কর্মরত শিক্ষক নয়, তাকে এমপিওভুক্ত আরবি প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেতে সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করে দিলেন কিভাবে জানতে চাইলে তিনি জানান, মাসুম আহমদ তাকে বিভ্রান্ত করেছে। তিনি জানান, মাদরাসার সুপার হিসেবে তিনি এবং সহ-সুপার মাওলানা আবু তোরাব মো: জসিম উদ্দিন এর স্তর পরিবর্তন করে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ হিসেবে পদায়নের জন্য দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। মাসুম আহমদকে কেবল বাইরে থেকে আনা হয়েছিলো, তাকে পদত্যাগপত্র দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকার পরিদর্শক (সিলেট বিভাগ) ড. মো: আবুল কালাম আজাদ বলেন, খুব সম্ভব অধ্যক্ষ কারসাজি করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ভুল তথ্য দিয়েছেন। একজন শিক্ষক এক সাথে দুই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে পারেন না। তিনি ভুক্তভোগীকে মহাপরিচালক বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অভিযোগের ব্যাপারে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে কর্তব্যরত ব্যক্তি জানান, অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আগামী সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রেরণ করা হবে। বিজ্ঞপ্তি