হাকালুকি হাওর এড়িয়ে পরিযায়ী পাখি

মাহফুজ শাকিল : এশিয়ার বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি নামে খ্যাত হাকালুকি হাওরে এবার জলচর পরিযায়ী পাখির সংখ্যা গত কয়েক বছরের তুলনায় কম দেখা মিলেছে। হাওরের বিভিন্ন বিলে দুই দিনব্যাপী পাখি শুমারির পর গত শনিবার (২৫ জানুয়ারি) রাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ তথ্য জানিয়েছেন। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের একটি প্রতিনিধি দল গত ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি হাকালুকি হাওরের ৪৫টি বিলে এ শুমারি চালায়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ওমর শাহাদাতের নেতৃত্বে আট সদস্যের দল শুমারিতে অংশ নেয়। বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর ও হাওরের উন্নয়নে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা সিএনআরএস (সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্সেস স্টাডিজ) শুমারিতে সহযোগিতা করে।

শুমারি দলের প্রধান ওমর শাহাদাত জানান, শুমারিতে হাওরে ২০২৫ সালে ৬০ প্রজাতির মোট ৩৫ হাজার ২৬৮টি পাখি পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে পিংলা বিলে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন বেয়ারের ভূতি হাঁস ২টি, নাগুয়া-লরিবাই বিলে বাংলাদেশের বিরল প্রজাতির বৈকাল তিলিহাঁস ১টি, প্রায় সংকটাপন্ন ফুলুরি হাঁস ৩টি, প্রায় সংকটাপন্ন মরচে রং ভূতিহাঁস ১ হাজার ৫শত ৮৮টি, প্রায় সংকটাপন্ন উত্তুরে টিটি ৬টি, সংকটাপন্ন কালো মাথা কাস্তেচরা ৩ শত ৯৩ টি এবং বিশ্বব্যাপী বিপন্ন পাতি ৯শত ০৯ টি।  এছাড়াও পিয়ং হাঁস ৫ হাজার ৫শত ৫২ টি, উত্তুরে ল্যাঞ্জ্যা হাঁস ৪ হাজার ২ শত ৭২ টি, এশীয় শামুকখোল ৪ হাজার ২ শত ২৮ টি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

হাওরে জলচর পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওমর শাহাদাত বলেন, পরিবেশের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরূপ প্রভাব এবং কৃষি আবাদে যথেষ্ট রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে এটা ঘটতে পারে। তিনি আরো বলেন, শুমারির সময় হাওরের বিভিন্ন বিলে মাছ ধরতে দেখা গেছে। কয়েকটি বিল প্রায় পানি শূন্য করে মাছ ধরা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি জলাশয়ে মৎস্য আহরণ পরিলক্ষিত হয়েছে। তাছাড়া পিংলা বিলের পাশে বিষটোপ (কার্বোটাফ) দিয়ে পাখি শিকার, নাগুয়া বিলে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়ে পাখি শিকার স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। হাতেনাতে ধরে জাল নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি পরিত্যক্ত মাছ ধরার ফাঁদ সমগ্র হাওরে ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর পর্যবেক্ষণ বলছে, গত ২০ বছরে সারা বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমেছে ৩৫ শতাংশ। হাকালুকিতে কমেছে ৪৫ শতাংশ। ২০০০ সালের আগে হাওরে বিচরণ করতো প্রায় ৭৫-৮০ হাজার পাখি। তার ৮০ শতাংশই হাকালুকি হাওরে ছিলো। ২০২৪ সালে হাকালুকি হাওরে পাখি শুমারি হয়নি। এর আগে ২০২৩ সালের শুমারিতে হাকালুকি হাওরে ৫২ প্রজাতির ৩৭ হাজার ৭৭৮টি, ২০২২ সালে ৫১ প্রজাতির ৩৬ হাজার ৫০১টি, ২০২১ সালে ৪৫ প্রজাতির ২৪ হাজার ৫৫১টি, ২০২০ সালে ৫৩ প্রজাতির ৪০ হাজার ১২৬টি, ২০১৯ সালে ৫১ প্রজাতির ৩৭ হাজার ৯৩১টি, ২০১৮ সালে ৪৪ প্রজাতির ৪৫ হাজার ১০০টি, ২০১৭ সালে ৫০ প্রজাতির ৫৮ হাজার ২৮১টি পাখির দেখা মিলেছিল।

শুমারিতে অংশ নেয়া অন্য সদস্যরা হলেন, ফা-তু-জো খালেক মিলা, সুলতান আহমেদ, মোঃ সাব্বির আহাম্মেদ, উজ্জ্বল দাস, আবু মুসা রাজু, মাহফুজ হিমেল এবং স্থানীয় পরিবেশকর্মী খোরশেদ আলম।

জানা যায়, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে হাকালুকি হাওর বিস্তৃত। বাংলাদেশে প্রায় ৭৩০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩৮৮ প্রজাতির পাখি’ই পরিযায়ী। শীতকালে পরিযায়ী হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে খাবারের সন্ধানে ছুঁটে আসে বাংলাদেশে। আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয়ে হাকালুকি হাওরের মতো জলাশয় গুলোকে। এ হাওরে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ২৩৮টি বিল।

হাকালুকি হাওর কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই অরক্ষিত হাওরে বিষটোপ আর ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করায় দিন দিন অতিথি পাখির সমাগম কমছে। মৎস্য অভয়াশ্রম থাকলেও সেই অভয়াশ্রম গুলোতে শিকারিরা হানা দেয়। শীতকালে এসব বিল ঘিরে পরিযায়ী পাখির বিচরণে মুখরিত হয়ে উঠত গোটা হাওরাঞ্চল। হাওরের বাস্তুতন্ত্র (ইকো সিস্টেম) রক্ষায় অবিলম্বে হাওরকে উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি হাওর তীরের মানুষের। ১৯৯৯ সালে সরকার হাকালুকি হাওরকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ বা ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া) ঘোষণা করে।

কয়েক বছর ধরে পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, শুধু হাকালুকি হাওরে নয়, কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব দেশেই পাখির সংখ্যা কমে আসছে। এর মূল দুটি কারণ হলো পাখির আবাসস্থল কমে যাওয়া ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পাখির আবাসস্থল কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আর বৈশ্বিক উষ্ণতা পাখির জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়ছে। এ পরিস্থিতি ঠেকাতে হলে পাখিদের আবাসস্থল রক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

ইনাম আল হক যোগ করে আরও বলেন, পাখি শিকারিদের অবাধ নিধনযজ্ঞে হাওরে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি চরম হুমকির মুখে আছে। পাখির সংখ্যা বাড়াতে হলে বা পাখি রক্ষা করতে হলে বিষটোপে শিকার বন্ধে আইনের পাশাপাশি নিরাপদ অভয়াশ্রম তৈরি করে তা সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মহিউদ্দিন রোববার বিকেলে বলেন, বিস্তীর্ণ হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। হাকালুকি হাওরের পরিবেশ যাতে বিনষ্ট না হয় সে বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। হাওরের কুলাউড়া অংশে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *