কুলাউড়ার সেই এতিম শিশুদের পাশে পুলিশ প্রশাসন

বিশেষ প্রতিনিধি : মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া দিনমজুর আতিক মিয়ার অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে পুলিশ প্রশাসন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও অনলাইনে ‘আব্বা আল্লাহর বাড়ি গেছোইন, আমরার লাগি পোলাও লইয়া আইবা’ শিরোনামে একটি মানবিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোঃ শফিকুল ইসলাম মানবিক ওই প্রতিবেদনটি দেখার পর তিনি মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোঃ ফারুক আহমেদ পিপিএম (বার) কে ফোন দিয়ে ওই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেন। পরে পুলিশ সুপার কুলাউড়া থানা পুলিশকে বিষয়টি জানালে দ্রুত একটি ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা (ডিএমপি’র কমিশনার, জেলা পুলিশ সুপার ও কুলাউড়া থানা পুলিশ) যৌথ অর্থায়নে ক্রয় করে ১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিকেলে অসহায় ওই পরিবারটির হাতে তুলে দেয়া হয়।
এসময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল) সাদেক কাওসার দস্তগীর, কুলাউড়া থানার অফিসার্স ইনর্চাজ বিনয় ভূষণ রায়, ওসি (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম, সিনিয়র সাংবাদিক এম. মছব্বির আলী, সমাজসেবক আব্দুল জলিল হাসনু, সুফিয়ান আহমেদ, কালের কণ্ঠ প্রতিনিধি মাহফুজ শাকিল, সমাজসেবিকা হাসিনা আক্তার ডলি, মরহুম আতিক মিয়ার বড় ভাই এলাই মিয়াসহ থানা পুলিশের সদস্যরা।
এর আগে সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি’র নজরে আসে মানবিক এই প্রতিবেদনটি। তিনি বিষয়টি মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের সাথে যোগাযোগ করে ওই পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী কালের কণ্ঠের প্রতিনিধিকে সাথে নিয়ে সদ্যপ্রয়াত আতিক মিয়ার বাড়িতে যান। এসময় তিনি সরকারের পক্ষ থেকে একটি পাকা ঘর নির্মাণ করে দেয়ার প্রতিশ্র“তি দেন। এদিকে কালের কণ্ঠের কুলাউড়া প্রতিনিধির সাথে দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এরমধ্যে হামদর্দ ল্যাবরেটরী ঢাকার ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোঃ জামাল উদ্দিন ভূঁইয়া রাসেল বিকাশের মাধ্যমে ১১ হাজার টাকা, ময়মনসিংহ থেকে মাহিন আহমদ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম থেকে দুলাল আহমদ ২ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা করেন। এছাড়া জেলা পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে ওই পরিবারকে এক মাসের খাদ্য সামগ্রী, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দীর্ঘমেয়াদে মাসিক ৫ হাজার টাকা করে দিবে, স্থানীয় সাপ্তাহিক সীমান্তের ডাকের পক্ষ থেকে সাড়ে ৪ বান্ডিল ঢেউটিন, ব্রাহ্মণবাজার অনলাইন প্রবাসী গ্র“পের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা ও এক মাসের খাদ্য সামগ্রী প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, কুলাউড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর আতিক মিয়া (৫৪) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় গত ২৪ নভেম্বর মঙ্গলবার ভোরে মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়ে পরিবারটি। মৃত্যুর সময় আতিক মিয়া স্ত্রী রফনা বেগমসহ তিন সন্তান আয়েশা বেগম (৮) তানজিনা বেগম (৪) ও রাফি মিয়া (২) রেখে যান। সরেজমিন ওই বাড়িতে গেলে আতিক মিয়ার চার বছরের শিশুকন্যা তানজিনাকে বাবা কোথায় জিজ্ঞেস করলে সে বলে ওঠে, ‘আব্বা আল্লাহর বাড়ি গেছোইন, আমরার লাগি পোলাও লইয়া আইবা।’ বাবা হারানো তানজিনার দৃষ্টিতে এখন শুধুই অজানা এক বিস্ময়ের ছাপ। এদিক সেদিক তাকিয়ে যেনো বাবার ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে। সে হয়তো বুঝতেই পারেনি তার বাবা এখন না ফেরার দেশে চিরঘুমে রয়েছেন। বাবার কথা চিন্তা করে বার বার মুর্চা যাচ্ছে চার বছরের ছোট্ট এই শিশুটি।
বাবাকে হারিয়ে ওই তিন শিশু অসহায় হয়ে পড়ে। তাদের কান্না যেন আর থামছে না। বাবাকে হারিয়ে তারা বিলাপ করছে, অবুঝ এই শিশুদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও নেই স্বজন-প্রতিবেশীদের।
সরেজমিনে আতিক মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাদের মাটির ঘরের জীর্ণ দেয়াল ধসে যাওয়ার উপক্রম এবং টিনের চালাও নষ্ট হয়ে গেছে দীর্ঘদিন থেকে। বিশাল ছিদ্র হয়ে গেছে টিনের চালায়। ঘরে নেই কোন বিছানা, তাই মাটির মেঝেতে সন্তানদের নিয়ে শীতের এই প্রকটের সময় রাত্রীযাপন করছেন রফনা বেগম। স্বামী আতিক মিয়ার রেখে যাওয়া জীর্ণঘরসহ ছোট্ট একটি ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই। স্বামী মারা যাওয়ার দিন ঘরে কোন খাবার ছিলোনা। গ্রামের মানুষের দেওয়া সহযোগিতায় সন্তানদের আহার জুটে।
আতিক মিয়ার স্ত্রী রফনা বেগম বলেন, আমার স্বামী দিনমজুর হিসেবে রাজমিস্ত্রির কাজ করে কোনমতে সংসার চালাতেন। কিন্তুু মহামারি করোনার থাবায় কোন কাজ না থাকায় বেকার হয়ে যান তিনি। গত একমাস ধরে হৃদরোগে (হার্টের ছিদ্র) আক্রান্ত হয়ে টাকার অভাবে সুচিকিৎসাও করতে না পারায় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাঁর কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে আমাদের পরিবার দুঃখÑকষ্টের মধ্যে দিয়ে কোনমতে চলছিলো।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল) সাদেক কাওসার দস্তগীর ও অফিসার্স ইনচার্জ বিনয় ভূষণ রায় বলেন, কালের কণ্ঠে মানবিক এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হলে ডিএমপি’র কমিশনার স্যার, পুলিশ সুপার স্যার ও কুলাউড়া থানা পুলিশের যৌথ অর্থায়নে ওই পরিবারকে একটি নতুন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা প্রদান করা হয়। রিকশাটি থানা পুলিশের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে।

এ সংক্রান্ত আগের নিউজ পড়তে নিচে ক্লিক করুন-

কুলাউড়ায় সেই এতিম বাচ্চাদের খাবার পাঠালেন

মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *